স্টাফ রিপোর্টার: জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ খসড়া প্রণয়ন করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে নির্বাচন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, দুর্নীতিদমন এবং পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইনি ও কাঠামোগত সংস্কারের পথনকশা নির্ধারিত হয়েছে।
এ বিষয়ে কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমরা সনদের খসড়া কপিটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছি। যাতে তারা এটার ভাষা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড পর্যালোচনা করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে তা সংলাপ শেষে চূড়ান্ত সনদে সংযোজন করা হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদে একটি বাধ্যতামূলক রোডম্যাপ নির্ধারিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ এবং দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদ ও পদ্ধতিগত দুর্নীতির কবলে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
খসড়া জুলাই সনদের ঘোষণাপত্রের ভূমিকা এবং উপসংহারে বলা হয়েছে, সনদে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেবে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণআন্দোলনে নিহত হাজারো মানুষের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাবে এবং এ সনদকে একটি সম্মিলিত নৈতিক দায় হিসেবে গ্রহণ করে তা পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। দেশের সাংবিধানিক কাঠামো, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতিদমন ব্যবস্থাকে আইনি ও নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করবে। নির্বাচিত পরবর্তী জাতীয় সংসদের প্রথম দুই বছরের মধ্যে সনদে উল্লিখিত সব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক আইনি গ্যারান্টি প্রদান করবে।
এছাড়াও, রাজনৈতিক দলগুলো সনদে বর্ণিত আইনি, ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক সুরক্ষাগুলোর সংরক্ষণ ও শ্রদ্ধা জানাবে, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে এ সনদকে স্বীকৃতি দেবে।
জুলাই সনদের ঘোষণার শেষাংশে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণ করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
`জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এসেছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। ওই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়, ওই আন্দোলেন ১৪ শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং আরও অনেক আহত হন। এ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন এবং চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। মোট ৩৫টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোট এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং ২০টি মূল বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মোট ৪৫টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এ প্রক্রিয়ায় ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয় – সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ বিগত ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেয়। পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেই সুপারিশগুলোকে একত্র করে দুটি ধাপে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্য তৈরির কাজ চালায়।
পরবর্তী পদক্ষেপ
‘জুলাই জাতীয় সনদ’কে অনেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সর্ববৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ হিসেবে উল্লেখ করছেন। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে কঠোর বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, ভবিষ্যৎ আইন প্রণয়ন এবং ফলোআপ রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সনদে বলা হয়েছে, এই সংস্কারগুলোকে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই কার্যকর করতে হবে।
জুলাই সনদে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রোববার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য এসেছে। এগুলাে হলো– সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ-(ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণার কাঠামো, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত বিধান, প্রধানমন্ত্রীর মেয়দাকাল ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।
কমিশনের সূত্রে আরও জানা গেছে, এর বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, সংসদে নারী আসন সংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রের মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
কমিশনের পক্ষ থেকে সোমবার (২৮ জুলাই) রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের খসড়া দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারা খসড়া জুলাই সনদ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে পরবর্তী মতামত দেবে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমাদেরকে খসড়া জুলাই সনদ-২০২৫ এর ভূমিকা এবং উপসংহারের অংশটি দিয়েছেন। সেটি এখনো পড়ে দেখিনি। এটা নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে কমিশনে মতামত দেব।
গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়নকারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, এটি আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, কোথাও ভাষাগত কোনো ভুল-ক্রটি আছে কি না তা দেখার জন্য।
একইসঙ্গে আরও কোনো শব্দ বা বাক্য যুক্ত করার থাকলে তা সুপারিশ করার জন্য।