স্টাফ রিপোর্টার : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার ছিল দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা, বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া, ন্যূনতম সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া। নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা নিশ্চয়তা গত এক বছরে সরকার দিতে পারেনি।
ফলে সহসা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে এবং এটা সরকারের বড় ব্যর্থতা বলে রাজনীতিবিদরা মনে করছেন। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং ‘মব’ সন্ত্রাসকে সরকার প্রশ্রয় দিচ্ছে, এমন অভিযোগও তুলছেন অনেকে।
আগামী ৮ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।
গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে পারেনি বলে মনে করছেন রাজনীতিকরা। ‘মব সন্ত্রাস’ সরকার প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং যারা ‘মব সন্ত্রাস’ করছে তারা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে—এমন অভিযোগের কথা বলছেন ওই নেতারা। সরকারের অগ্রাধিকার কাজ ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের হত্যা, দুর্নীতির বিচার এবং একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। শুরুতেই সরকার সংস্কার কার্যক্রমে হাত দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করে চলেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য হয়নি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলা হলেও সরকার এখনো সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেনি। নির্বাচন কবে হবে, সে নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারছে না। এই সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম যতটুকু সংস্কার করা দরকার, সেটা করে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া। কিন্তু সরকার অনেক বিস্তৃত পরিসরে সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে, যেটা নির্বাচিত সরকারের কাজ। ফলে নির্বাচন আরও বিলম্বিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এবং নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ বাড়ছে বলে রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন।
আবার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিতেও নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপ এবং এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকার কোনো সমাধান করতে পারেনি। এটি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া সরকার এমন কিছু কাজে হাত দিয়েছে, বিশেষ করে বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি সহযোগিতাসহ বেশ কিছু বিষয়ে, যা অনির্বাচিত সরকারের কাজের আওতার মধ্যে পড়ে না বলে রাজনীতিবিদরা মনে করছেন। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বিষয়ে সরকারের কিছুটা অর্জন বা সফলতা রয়েছে বলে তারা মনে করছেন। সেটা হচ্ছে বিদেশ থেকে, প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্স ভালো এসেছে। এ কারণে ব্যাংকে রিজার্ভ বেড়েছে বলে তারা জানান।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের সফলতা বা ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি, প্রবীণ রাজনীতিবিদ শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, একমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু ভারসাম্য আনা ছাড়া এই অন্তর্বর্তী সরকারের আর তেমন কোনো সফলতা দেখছি না। সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে আসার জন্য আলোচনা চলছে। কিন্তু এখনো কাঙ্ক্ষিত ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো সফলতা দেখছি না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চয়তাপূর্ণ কোনো অগ্রগতি এখনো দেখা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা যে সময়ে নির্বাচনের কথা বলেছেন তার মধ্যেও ফাঁক রয়েছে। বলা হয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে যদি প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করা যায় তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ধরনের কথার মধ্যে অনেক ফাঁক থেকে যায়। বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর পরিচালনার জন্য ভালো বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার কথা, এখানে ভালো বলতে সরকারের কথা অনুযায়ী ভালো। এটা তো সন্দেহজনক বিষয়, দেশের মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কেবল নির্বাচিত সরকারি নিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরাই উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। সবকিছুতেই বিশৃঙ্খলা। মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা, গোপালগঞ্জের ঘটনা, সবকিছুতে যেন একটা বিশৃঙ্খলা চলছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে যে নতুন রাজনৈতিক দল হয়েছে, সে দলকে সরকার সহযোগিতা ও প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এনসিপি ড. ইউনূসের দল বলে জনগণ মনে করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এখন নির্বাচনটাই বড় কাজ। নির্বাচনের জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করা দরকার, সেগুলো নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। ‘মব সন্ত্রাস’ বন্ধ হয়নি, অনেকে মনে করেন ‘মব সন্ত্রাস’ সরকার প্রশ্রয় দিচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে মনে হয় নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, এ সরকারের যেসব কাজ করার কথা ছিল, সেগুলো করতে পারেনি। এ কারণে সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। মব সন্ত্রাস ঘটেই চলেছে, ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না। একটা অর্জন বিদেশ থেকে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্সটা ভালো এসেছে। এ কারণে ব্যাংকে রিজার্ভ বেড়েছে। সংস্কার, বিচার প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়নি। ঢালাওভাবে মামলা হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সংস্কারের জন্য ১৬৬টি বিষয় নিয়ে এসেছে। ১৬টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, একমত হওয়া গেছে নয়-দশটি বিষয়ে। আমরা বলেছি, যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে। নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। এখন ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের মধ্যে রয়েছে। এতে নির্বাচন কবে হবে সেটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। অনেক বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। মব সন্ত্রাস করে হত্যাকাণ্ড ঘটানো, মাইলস্টোন স্কুলের মর্মান্তিক ঘটনা, গোপালগঞ্জের ঘটনা—সবকিছু মিলিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ, এগুলো নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা কি না।
বাংলাদেশ জাসদের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাক হোসেন বলেন, এই সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার ছিল দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা, বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া, ন্যূনতম সংস্কার করা এবং সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই, সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাস বা মব সন্ত্রাস যারা করছে, তারা সরকারকে ভয় পাচ্ছে না। তারা ইমিউনিটি পেয়ে যাচ্ছে, যেন ধরার কেউ নেই। নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার করার দরকার ততটুকুই করে নির্বাচন দেওয়ার দরকার ছিল। সরকার নির্বাচনের দিকে না গিয়ে একটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও এর অংশ হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন তো বেশিদিন থাকে না। সরকার যে সময়ে নির্বাচনের কথা বলছে, এটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে যে, সেই সময়েই নির্বাচন হবে। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যেটা হয়েছে, সেটা চলতেই থাকবে। গুরুত্বসহকারে ও আন্তরিকভাবে নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে হবে। গোপালগঞ্জের ঘটনা, মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনা ও পরবর্তী পরিস্থিতি, সচিবালয়ের ঘটনা—এসব ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষ জেনে যাবে সরকার কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এতে সমস্যা আরও বাড়বে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, প্রথমদিকে তারা কিছু কিছু করতে পেরেছে। কিন্তু এত বেশি এজেন্ডা হাতে নিয়ে ফেলেছে, যেগুলো এই সরকারের কাজ না। যার ফলে একের পর এক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কোনো কিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা মানুষ যদি জেনে যায় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না।