মাসুম বাদশাহ সিংগাইর (মানিকগঞ্জ) থেকে : ২০২৫ সালজুড়ে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা যেন একের পর এক সহিংসতার সাক্ষী। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হত্যা, জমি বিরোধে সংঘর্ষ, অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার, ডাকাতির মারধর ও পারিবারিক কলহে প্রাণহানির ঘটনায় পুরো উপজেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ধারাবাহিক এসব ঘটনায় জনমনে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
বছরের প্রথম হত্যার ঘটনা ঘটে ২৩ জানুয়ারি। সিংগাইর উপজেলার ঘোনাপাড়া মোড় এলাকায় হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ সড়ক থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন থাকায় পুলিশ এটিকে হত্যাকাণ্ড বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে।
৩০ এপ্রিল উপজেলার রায়দক্ষিণ এলাকায় নাতনিকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় আলি আসগর (৬০) নামে এক বৃদ্ধকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত আলি আসগর থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই খুন হন বলে পরিবারের দাবি। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
২০ মে ধল্লা ইউনিয়নের খাসের কোলপাড় এলাকার হানিফ ডাঙ্গার কাছে তুচ্ছ বাক-বিতণ্ডার জেরে কিশোর রাহুল খান (১৭) কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিশোরদের মধ্যকার এই সহিংসতা নতুন করে প্রশ্ন তোলে তরুণ সমাজের অপরাধ প্রবণতা নিয়ে।
১৭ আগস্ট ইসলামনগর এলাকায় ডাকাতদের মারধরের শিকার হন মোহর উদ্দিন (৭০)। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় তার ছেলে নুর মোহাম্মদ বাবু (৩০) আহত হন। পরে র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে একাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৪ অক্টোবর আঠালিয়া গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হানিফ (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত হানিফ এলাহ বেপারির ছেলে। এ ঘটনায় তার আপন ভাই ও চাচাতো ভাতিজাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, যা পারিবারিক বিরোধের ভয়াবহ রূপ আবারও সামনে আনে।
এদিকে চান্দহর ইউনিয়নের চর চামটা আনন্দবাজার এলাকায় নুরুল ইসলামের বাড়ির পাশের কাঁচা রাস্তা থেকে জাকির নামে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করা হতে পারে।
২২ নভেম্বর ধল্লা ইউনিয়নের চরউলাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে শারফিন মোল্লা (৬০) কে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় প্রধান আসামি রউফুল মুন্সিসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বছরের শেষ ভাগেও থামেনি সহিংসতা। ২৫ ডিসেম্বর জামশা ইউনিয়নের উত্তর জামশা নয়াপাড়া গ্রামে একটি নির্জন ঘর থেকে ফাইজুদ্দিন (৫০) এর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী শিউলী আক্তার ও তার প্রেমিক সাইদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সবশেষ ২৭ ডিসেম্বর দক্ষিণ জামশা গ্রামে জমি বিরোধের জেরে সৎ ভাইয়ের ছেলের ছোড়া ইটের আঘাতে আমির খান (৫৫) নিহত হন। নিহতের মেয়ে বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।
এছাড়াও সারা বছরজুড়ে চান্দহর, জামশা ও ধল্লা ইউনিয়নে চুরি, বাড়িঘরে হামলা, গবাদিপশু ও ফসল লুটের অভিযোগ উঠে আসে।
এ বিষয়ে সিংগাইর থানার ওসি মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, “অপরাধের ঘটনাগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। অধিকাংশ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপরাধ পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত টহল, বিশেষ অভিযান ও কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করা হয়েছে।”
স্থানীয়দের মতে, শুধু পুলিশি তৎপরতা নয়, সামাজিক সচেতনতা, পারিবারিক বিরোধের দ্রুত নিষ্পত্তি এবং তরুণদের অপরাধমুখী প্রবণতা রোধে সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে সিংগাইরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন কঠিন হবে।
