স্টাফ রিপোর্টার : চব্বিশের ৫ আগস্ট পরবর্তী নানামুখী চাপে লাগাতার দাম কমলেও চলতি সপ্তাহে হঠাৎ করেই চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে বাড়ছে চিনির দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারটিতে প্রতিমণ চিনির দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাদা চিনি আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশে পরিশোধিত চিনির দাম বাড়ছে। আর কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, ডিসেম্বর মাসে মেশিন ওভারহোলিং করতে হয়। এজন্য পরিশোধন বন্ধ থাকায় সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যক্রমে প্রশাসন ব্যস্ত থাকার সুযোগে সক্রিয় হচ্ছে চিনির মিলার সিন্ডিকেট। পাশাপাশি রমজান সামনে রেখে পণ্যের দাম বাড়ানোর অপকৌশল হিসেবে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন ভোক্তাদের সংগঠন- কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে পাইকারি বাজারে চিনির দাম ছিল মণপ্রতি চার হাজার ৪৪০ টাকা। একই বাজারে গত নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সেই চিনির দাম মণপ্রতি তিন হাজার ২১০ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে পাইকারি বাজারে হঠাৎ বাড়তে শুরু করেছে চিনির দাম। তবে খুচরা বাজারে এখনো এর প্রভাব পড়েনি।
জানা যায়, দেশে বছরে কমবেশি ২০ থেকে ২২ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ৩০ হাজার টনের মতো। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় ১৫ চিনিকলে ৩০ হাজার ৮০ টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়।
দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি চিনি আমদানি করতে হয়। দেশে ব্যক্তিখাতের পাঁচ শিল্পগ্রুপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। এর মধ্যে আবদুল মোনেম লিমিটেডের ইগলু ব্রান্ডের চিনির কলটি কিনে নেয় দেশের আরেক জায়ান্ট শিল্প গ্রুপ আবুল খায়ের গ্রুপ। এদিকে আমদানির পর নিজেদের মিলে পরিশোধন করে চিনি বাজারজাত করে মিলার কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে দেশবন্ধু সুগার মিলে নানান জটিলতায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি হাসিনা সরকারের পতনের পর বেকায়দায় পড়লেও এখনো চিনির সরবরাহ দিয়ে আসছে এস আলম গ্রুপ। অতিসম্প্রতি এস আলম সুগারও চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬০ টন চিনি আমদানি হয়। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনি রয়েছে ৯ লাখ ৩ হাজার ৭২ টন এবং পরিশোধিত সাদা চিনি ৮২ হাজার ৬৮৮ টন। অপরিশোধিত চিনির মধ্যে আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৯ হাজার ৬৬৯ টন, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ৩ লাখ ১৬ হাজার ২৩৫ ট, দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড ৫ হাজার ৫০০ টন, মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৫ লাখ ৩ হাজার ৬২৩ টন এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ৬৭ হাজার ৬৩৮ টন এবং প্রাণ ডেইরি লিমিটেড ৪০৬ টন।
অপরিশোধিত চিনির পুরোটাই আমদানি হয় ব্রাজিল থেকে। সরকারি অনুমোদন নিয়ে গত অর্থবছরে রিফাইন্ড সাদা চিনি আমদানি করে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। তাছাড়া কারখানার কাঁচামাল হিসেবেও রিফাইন্ড চিনি আমদানি হয়।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে (১ জুলাই থেকে ২৫ নভেম্বর) অপরিশোধিত ও পরিশোধিত মিলে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫১১ টন চিনি আমদানি হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ লাখ ৫ হাজার ৭৫১ টন বেশি আমদানি হয়েছে। অপরিশোধিত চিনির মধ্যে মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড আমদানি করে ৫ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৩ টন, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ২ লাখ ৮১ হাজার ৫৫১ টন, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৪ লাখ ২১ হাজার ৪৯৬ টন এবং এস আলম সুগার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ৪৬ হাজার ১১৪ টন।
ভোগ্যপণ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গিয়ে সরেজমিনে কথা হয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, একমাস আগেও চিনির পাইকারি দাম মণপ্রতি ৩ হাজার ২১০ টাকায় আসে। এরপর ৩ হাজার ২৫০ টাকার মধ্যে দাম সীমাবদ্ধ থাকলেও এক সপ্তাহ আগে থেকে আবারও বাড়তে থাকে চিনির দাম। রোববার প্রতিমণ চিনি বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪১০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের ইমাম শরীফ ব্রাদার্সের পরিচালক ছৈয়দুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোববার সপ্তাহের শুরুতে খাতুনগঞ্জে রেডি (চাহিদামাত্র সরবরাহযোগ্য) চিনি মনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩৪০০-৩৪১০ টাকায়। মিল থেকে এখন চিনি সরবরাহ নিতে গেলে সিরিয়াল দিতে হচ্ছে। সিরিয়ালের ডিওগুলো মণপ্রতি ৩৩৬০-৩৩৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিলভেদে ১১ দিন পর্যন্ত সিরিয়াল লাগছে।’
খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী শাহজাহান বাহাদুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের বাজারে গত এক বছরে চিনির দাম লাগাতার কমেছে। কিন্তু কস্টিং (উৎপাদন মূল্য) বেশি ছিল। এতে মিলাররা বড় অঙ্কের লোকসান গুনেছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে চিনির দাম কিছুটা বেড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছক খাতুনগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোববার এস আলম গ্রুপের চিনিও ৩ হাজার ৪১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এস আলম সুগার মিলের চিনির ডিও মেসার্স এম এ সালামের অফিস থেকে বিক্রি হয়। এখন এস আলম ফ্যাক্টরি থেকে চিনির সরবরাহও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ফ্রেশ চিনির ডিও বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩২০ টাকায়। ফ্রেশ চিনি কিনে সরবরাহ নিতে মিলগেটে কমপক্ষে চারদিন সিরিয়ালে থাকতে হচ্ছে।’
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর থেকে সরকার সাদা চিনি আমদানি সুযোগ দিয়েছিল। এতে বাজারে চিনির দাম নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন আবার সাদা চিনি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ কারণে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পরিশোধিত চিনির দাম কিছুটা বাড়ছে।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজানকে সামনে রেখে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলোর অপতৎপরতা বেড়ে যায়। তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ খোঁজে। যে কারণে বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যক্রমে প্রশাসন ব্যস্ত থাকার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এমনটাই মনে করছেন নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রশাসন এখন নির্বাচনি কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সিন্ডিকেটগুলো।
এস আলম সুগার রিফাইন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের এজিএম (অ্যাকাউন্টস) মিন্টু চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, ডিসেম্বর মাসে মেশিন ওভারহোলিং করতে হয়। এজন্য প্রোডাকশন বন্ধ থাকে। দুয়েকদিনের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সিন্ডিকেটের বিষয়টি সঠিক নয়।
