শুক্রবার, 26 ডিসেম্বর 2025
MENU
#
ফলাফল বিপর্যয় ও শিক্ষক আন্দোলন: বছরজুড়ে অস্থির ছিল শিক্ষাখাত
daily-fulki

ফলাফল বিপর্যয় ও শিক্ষক আন্দোলন: বছরজুড়ে অস্থির ছিল শিক্ষাখাত


স্টাফ রিপোর্টার : বছরজুড়ে চরম সংকট, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে দেশের শিক্ষাখাত। ২০২৫ সালজুড়ে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। বছরের শুরুতে সময়মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই না পাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়ে শিক্ষার্থীরা। প্রায় আড়াই মাস পর ধীরে ধীরে সেই সংকট কাটলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নিয়মিত পাঠদান প্রক্রিয়ায়।


এরপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে বড় ধরনের ধস নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করে। একই সময়ে বেতন-ভাতা, গ্রেড ও চাকরির নিরাপত্তার দাবিতে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের আন্দোলন শিক্ষা কার্যক্রমকে মারাত্মক ব্যাহত করে। এর মধ্যে দীর্ঘ ১২ বছর পর অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালুর ঘোষণায় কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও প্রাথমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষা আইনি জটিলতায় আটকে যায়।

বই বিতরণে বিলম্ব, ফল বিপর্যয়, ধারাবাহিক শিক্ষক আন্দোলন এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা– সবকিছু মিলিয়ে পুরো বছরজুড়ে শিক্ষাখাত চরম চাপের মুখে ছিল। যা এই খাতের ব্যবস্থাপনাগত সীমাবদ্ধতা ও নীতিগত চ্যালেঞ্জগুলোকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। একইসঙ্গে, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ড ও ছাত্রদল নেতাদের তৎপরতা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে।

চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কয়েক বছর তুলনামূলক ভালো ফলের পর এবার দুই স্তরের পরীক্ষার ফলে বড় ধরনের ধস নামে।

শিক্ষাবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এ বছর পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম এবং গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। ইংরেজি ও গণিতে ব্যাপক ফেল এসেছে। বরিশাল বোর্ডে পাসের হার নেমে এসেছে ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশে, আর রাজশাহী বোর্ডে সর্বোচ্চ ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ।


২ লাখ শিক্ষার্থীর ৪ লাখ খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন
ফেল থেকে পাস ১৪৭৯ জন, জিপিএ-৫ পেলেন ৫৫৫ শিক্ষার্থী
জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৩ হাজারের বেশি কম। ছাত্রীদের পাসের হার ৭০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, আর ছেলেদের ৬৫ দশমিক ১১ শতাংশ।

 

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলেও একই চিত্র দেখা যায়। ১১টি বোর্ডে গড় পাসের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অংশগ্রহণকারী ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জনের মধ্যে পাস করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২টি।

ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, এই ফল কেবল সংখ্যার পতন নয়; বরং দীর্ঘদিনের গুণগত দুর্বলতা, বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতির ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।

২০২৫ সালের প্রায় পুরো সময়জুড়ে বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে সরব ছিলেন শিক্ষকরা। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নন-এমপিও এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠদান বারবার ব্যাহত হয়েছে।

বছরের শুরুতে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে শাহবাগ ও প্রেসক্লাব এলাকায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস পেয়ে তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেও পরবর্তী সময়ে বাস্তব কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।


একই সঙ্গে, জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বছরজুড়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। নন-এমপিও শিক্ষকরাও নতুন এমপিওভুক্তির দাবিতে তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এছাড়া, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে একাধিকবার কর্মবিরতি পালন করেন।

শিক্ষকদের দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শেষ পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়ানোর আশ্বাস দেয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি এই আন্দোলনের ফলে বছরজুড়ে শিক্ষা কার্যক্রমে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল, তা শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

তিন দফা দাবিতে গত নভেম্বরের শেষ দিকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে যান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। তাদের প্রধান দাবিগুলো ছিল– ১১তম গ্রেড প্রদান, শতভাগ পদোন্নতি নিশ্চিতকরণ এবং উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতা নিরসন।

আন্দোলন একপর্যায়ে আরও বেগবান হয় এবং শিক্ষকরা বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। এতে সারা দেশের প্রায় ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার শিক্ষকদের এই আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। মোট ৪২ জন শিক্ষককে বিভিন্ন জেলায় শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। সরকারের এমন কঠোর পদক্ষেপের মুখে গত ৪ ডিসেম্বর রাতে শিক্ষকরা তাদের আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এর ফলে সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে গত ৭ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে একযোগে নিয়মিতভাবে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়।

একযুগ পর ফিরেছে অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা

দীর্ঘ ১২ বছর পর অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা ফের চালু হওয়ায় শিক্ষাঙ্গনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। ২০২৫ সালে এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে মোট তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫৯১ জন শিক্ষার্থী।

বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়– এই পাঁচ বিষয়ে মোট ৪০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার দিনে সারাদেশের ৬১১টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

 

২০২৫ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইনি জটিলতায় তা শেষ পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায়। নীতিমালায় শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখায় এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করেন বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এক মাসের জন্য বৃত্তি পরীক্ষা এবং বিকল্প ‘মেধা যাচাই পরীক্ষা’ স্থগিতের আদেশ দেন।


আদালত ২০০৮ সালের নীতিমালার আলোকে বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ প্রদান করেন। আদালতের এই আদেশের ফলে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বৃত্তি পরীক্ষা চালুর যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, তা আবারও গভীর অনিশ্চয়তায় পড়ে।

সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল ছিল দেশের শিক্ষাখাতের জন্য সংকট, সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জে ভরা একটি বছর। দফায় দফায় অস্থিরতা এবং নীতিগত টানাপড়েনের সরাসরি প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর।

 

সর্বাধিক পঠিত