স্টাফ রিপোর্টার : দীর্ঘ ১৭ বছরের বেশি সময় পর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে ঢাকায় মানুষের ঢল নামতে শুরু করেছে। সবাই ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে চায়। দূর থেকে হলেও একনজর দেখতে চায়, তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে চায়।
এ জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে যে যেভাবে পারছে, ঢাকার দিকে ছুটছে। এরই মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ ঢাকায় এসেছে। আজ বুধবারও সবার গন্তব্য ঢাকা। বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ৫০ লাখ মানুষের সমাগমের প্রত্যাশা করছে বিএনপি।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তারেক রহমানকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নিয়মিত ফ্লাইটটি অবতরণের কথা। এর আগে আজ বুধবার লন্ডনের স্থানীয় সময় ৬টা ১৫ মিনিটে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন তিনি।
ফ্লাইটটি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছবে।
তারেক রহমানের সঙ্গে একই বিমানে তাঁর সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমান, মিডিয়া টিমের আবু আবদুল্লাহ সালেহ, পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট আব্দুর রহমান সানি ও তাবাসসুম ফারহানা নামের আরেকজনের আসার কথা রয়েছে।
বিমানবন্দরে পৌঁছলে দলের শীর্ষ নেতারা তারেক রহমানকে স্বাগত জানাবেন। এ ছাড়া ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থী, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে এদিনের কর্মসূচি সফল করবেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিটের গণসংবর্ধনাস্থলে আসবেন এবং সেখান থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবেন।
তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় করে রাখতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
শুধু দলের নেতাকর্মীই নন, সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এদিন রাজধানী ঢাকা জনসমুদ্রে পরিণত হবে বলে আশা করছেন দলের নেতারা। তাঁদের প্রত্যাশা, ইতিহাসের সর্বাধিকসংখ্যক লোকের জমায়েত হবে তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে। এ ব্যাপারে সারা দেশের নেতাকর্মীদের এরই মধ্যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলো ছাড়াও অন্য সব জেলা থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে। বিএনপিসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনকেই পৃথক প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে সর্বোচ্চ জনসমাগম ও নিরাপত্তা এবং পুরো প্রক্রিয়া সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন নেতারা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি দল থেকেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর ৩০০ ফিটে গণসংবর্ধনা দেওয়ার জন্য বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।
২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের সংবর্ধনায় মানুষের মহামিলন হবে বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছরের বিরতির পর আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেদিন তারেক রহমানের সংবর্ধনায় মানুষের মহামিলন হবে। অর্ধকোটি মানুষের উপস্থিতি আশা করছেন তিনি।
সংবর্ধনায় উপস্থিতির ইতিহাস সৃষ্টি হবে—এমনটা দাবি করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, ঢাকা মহানগরের সব ওয়ার্ড, থানা থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টি হবে বৃহস্পতিবার। জনসমুদ্রে পরিণত হবে ঢাকা। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শুধু বিএনপির নেতাই নন, তিনি এ দেশের মা-মাটি-মানুষের নেতা। তাঁকে স্বাগত জানাতে এদিন দল-মত-নির্বিশেষে সবাই ছুটে আসবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁরা বাড়তি শক্তি দেখাতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে ঢাকায় আসছেন।
গতকাল সংবর্ধনা মঞ্চের কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনে গিয়ে রুহুল কবীর রিজভী বলেন, অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি দল থেকেও সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, দেশে পৌঁছার পর তারেক রহমান প্রথমে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এরপর এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে তাঁর মা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবেন।
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার প্রতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিটের গণসংবর্ধনা স্থান এবং গুলশান পর্যন্ত কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে তারেক রহমানের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্সসহ একাধিক টিম কাজ করবে। এ ছাড়া দলের বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের সমন্বয়েও একটি টিম গঠন করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা পর্যন্ত তারেক রহমানকে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা দিতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তারেক রহমান দেশে এলে তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ কোনো ঝুঁকির তথ্য নেই। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর নিরাপত্তায় কোথাও যেন কোনো ফাঁক না থাকে, এ বিষয়টি ভালোভাবে তদারকি করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশে ফেরার পর তারেক রহমান যাতায়াতের সময় পাবেন পুলিশি পাহারাসহ বিশেষ নিরাপত্তা। এ ছাড়া তাঁর বাসভবন ও অফিসেও থাকবে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও গোয়েন্দারা তারেক রহমানের নিরাপত্তার দিকটি দেখভাল করবেন। এ ছাড়া তারেক রহমান বিমানবন্দর থেকে গুলশানে আসার পথে কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই দিন তাঁর নিরাপত্তায় মাঠে থাকবেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সোয়াট টিম এবং বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা। তাঁর বাসা ও অফিস ডগ স্কোয়াড দিয়ে সুইপিংয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে পুলিশ।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ‘আমাদের প্রিয় অভিভাবক দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরছেন, এটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের দিন।’
তারেক রহমানের এই ফেরাকে স্মরণীয় করতে ছাত্রদল ধারাবাহিকভাবে প্রস্তুতিকাজ করে যাচ্ছে। সেদিন লাখো নেতাকর্মী বিমানবন্দর এলাকায় উপস্থিত হয়ে তারেক রহমানকে স্বাগত জানাবেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম নয়ন বলেন, তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পক্ষ থেকে সেদিন লক্ষাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত থাকবেন।
১০ রুটে স্পেশাল ট্রেন : বিএনপির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ২৫ ডিসেম্বর সারা দেশের ১০টি রুটে স্পেশাল ট্রেন চলবে। কক্সবাজার থেকে পঞ্চগড়, খুলনা থেকে রাজশাহী—দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্ত থেকে ঢাকামুখী হচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। রেলওয়ে জানিয়েছে, এদিন স্পেশাল ট্রেন ও অতিরিক্ত কোচ সংযোজনের মাধ্যমে আনুমানিক ৩৬ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হবে। তবে নির্বাচনী আচরণবিধি-২০২৫ কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর দীর্ঘ ১৭ বছরের বেশি সময়। দিনের হিসাবে ছয় হাজার ৩০৯ দিন। প্রিয় জন্মভূমি থেকে আট হাজার কিলোমিটার দূরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সময়ে নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে নিজে ছিলেন চিকিৎসাধীন, ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের কারণে হারিয়েছেন প্রিয় ছোট ভাইকে, মাকে দেখেছেন কারাবন্দি হতে। দেখেছেন হাজার হাজার নেতাকর্মীর গুম-খুন, হামলা-মামলা। প্রতি মুহূর্তে সহ্য করেছেন জন্মভূমিতে ফিরতে না পারার অসহ্য যন্ত্রণা। কেঁদেছেন দেশের মা-মাটি ও মানুষের জন্য। দেশ ও দেশের মানুষও যেন তারেক রহমানের এই শূন্যতা অনুভব করেছে তীব্র থেকে তীব্রতরভাবে। বিশেষ করে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে তারেক রহমানকে মাতৃভূমিতে ফিরে পেতে গুনছিল অপেক্ষার প্রহর। অবশেষে শেষ হতে চলেছে দীর্ঘ সেই প্রতীক্ষা। রাত পোহালেই দেশের কোটি কোটি মানুষের সামনে উপস্থিত হবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
২৭ ডিসেম্বর ভোটার হবেন তারেক রহমান : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, আগামী ২৭ ডিসেম্বর তারেক রহমান ভোটার হবেন। গত সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘২৫ তারিখ হচ্ছে বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ২৬ তারিখ। শনিবার ২৭ তারিখ। নির্বাচনকালীন এই সময় নির্বাচন কমিশনের অফিস সব খোলা থাকে। সেই দিনই এই ভোটার হওয়া ভোটার আইডি বা ন্যাশনাল আইডি হওয়া সংক্রান্ত যা কিছু আছে, তিনি এই ২৭ তারিখে করবেন।’
স্বাগত জানিয়ে মিছিল : তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে স্বাগত মিছিল করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক নেতৃবৃন্দ, সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদল। গতকাল বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি হাসপাতাল) বটতলা থেকে একটি মিছিল শুরু করে শাহবাগ মোড় হয়ে মৎস্য ভবনে গিয়ে শেষ হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসভাপতি এবং বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কমিটির সদস্য ডা. তৌহিদুর রহমান আউয়ালের নেতৃত্বে মিছিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী।
আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামসহ বিএনপির অঙ্গসংগঠন, ডাক্তার, ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
