স্টাফ রিপোর্টার : অবৈধ দখল, শিল্পবর্জ্য ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে সাভারের নদী, জলাশয় ও পরিবেশ আজ চরম সংকটে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সমন্বিত ও তাৎক্ষণিক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত এক আলোচনা সভায়।
মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সাভার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘সাভারের নদী, জলাশয় ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ জিয়াউল হক। সভাপতিত্ব করেন বেলার হেড অব প্রোগ্রাম ফিরোজুল ইসলাম মিলন। স্বাগত বক্তব্য দেন বেলা প্রোগ্রাম অ্যান্ড ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর এ এম এম মামুন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেলার লিগ্যাল কো-অর্ডিনেটর ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস হাসানুল বান্না।
তিনি বলেন, গত চার দশকে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৩২ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং নিম্নভূমি ৫২ দশমিক ৫৮ শতাংশ কমে গেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ বন্যা প্রবাহ এলাকা ও জলাভূমি ভরাট হয়েছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১২ মিটারেরও বেশি নিচে নেমে গেছে।
প্রবন্ধে সাভারের ভৌগোলিক বাস্তবতা তুলে ধরে এস হাসানুল বান্না বলেন, তিনদিকে বংশী, ধলেশ্বরী ও তুরাগ নদী এবং মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা ও গাজীখালী নদীসহ অসংখ্য খাল একসময় সাভারের পরিবেশকে প্রাণবন্ত রেখেছিল। কর্ণপাড়া, ভরারী, ঋষিপাড়া, নয়নজুলি, তেঁতুলঝোড়া ও ঘুঘুদিয়া খালের পাশাপাশি ধলাইবিল, পাকুরিয়াবিল, তাঁতিবিল, শুকনাবিল ও নওয়াদ্দাবিলের মতো বহু বিল আজ বিলুপ্তির পথে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের ২০২৩ সালের এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালে ঢাকার মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশে।
আলোচনায় অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জলাশয় ও নিম্নভূমি ধ্বংসের পেছনে প্রধান কারণ অবৈধ দখল ও ভরাট, শিল্প ও কঠিন বর্জ্য নিক্ষেপ, ট্যানারি বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন, ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। রাজধানীর কাছাকাছি হওয়ায় সাভার, আশুলিয়া ও তুরাগ এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দূষণকারী শিল্পকারখানা। এর প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্য ও কৃষিতেও।
আলোচনা সভায় জানানো হয়, আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বায়ুদূষণে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে। বায়ুদূষণের কারণে দেশের মানুষের গড় আয়ু বছরে প্রায় ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে সাভারে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৬৪ দিন বায়ুমান ছিল মানমাত্রার বাইরে। এ কারণে এলাকাটিকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, হেমায়েতপুর এলাকায় প্রায় ১০ লাখ পরিবারের জন্য কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই।
তিনি বর্জ্য পৃথকীকরণ, ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং দূষণের তথ্য পরিবেশ অধিদপ্তরের হটলাইনে জানানোর ওপর গুরুত্ব দেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, কর্ণপাড়া খাল রক্ষায় তৎপরতা বাড়াতে হবে, শিল্পকারখানার ইটিপি নিয়মিত চালু রাখতে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন এবং প্রতি মাসে তরল বর্জ্যের নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
