স্টাফ রিপোর্টার : বিক্ষুব্ধ জনতার হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের প্রধান কার্যালয়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভবন দুটিতে দেখা গেছে ভয়াবহতা। হামলার সময় বৃহস্পতিবার রাতে ডেইলি স্টার ভবনের সামনে হেনস্তার শিকার হয়েছেন ইংরেজি দৈনিক নিউএজ সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর। পরিস্থিতি আতঙ্কিত করে তুলেছে দেশের পুরো গণমাধ্যমকে। অন্যান্য গণমাধ্যমেও আতঙ্ক কাজ করছে। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। এদিকে গতকাল সকাল থেকেই প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে ভিড় করে উৎসুক জনতা। ভবন দুটির সামনে দাঁড়িয়ে আঁতকে উঠছেন অগ্নিসংযোগের সময় ভিতরে অবরুদ্ধ থাকা গণমাধ্যম দুটির কর্মীরা। কেউ কেউ বেঁচে ফেরার স্মৃতি বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মোতায়েন রাখা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত ফোর্স। ক্ষতিগ্রস্ত প্রথম আলোর ভবন পরিদর্শন করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। হামলাকারীদের চিহ্নিত করে এ ঘটনায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। দুপুরে আইজিপি বাহারুল আলম প্রথম আলোর ভবনটি পরিদর্শনকালে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শোনেন। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মো. ইবনে মিজান বলেন, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে দুটি ভবনের সামনেই অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন আছে। এখনো গণমাধ্যম দুটির পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। প্রত্যক্ষদর্শী ও দুটি পত্রিকার সংবাদকর্মীরা জানান যে, শুধু অগ্নিসংযোগ নয়, ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে।
প্রথম আলোর কর্মীদের মানববন্ধন : হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রথম আলোর কর্মীরা। গতকাল বিকালে কার্যালয়ের সামনে ‘প্রথম আলোর ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ’ লেখা ব্যানার হাতে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে অংশ নেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকসহ সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শরিফ ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ছিল একটি কালো দিন।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বক্তব্য দেওয়ার সময় কয়েকজন ব্যক্তি হট্টগোল শুরু করেন। তারা প্রথম আলোর উদ্দেশে গালাগাল করেন। এ পরিস্থিতিতে কর্মসূচি দ্রুত শেষ করে প্রথম আলোর কর্মীরা বিক্ষোভস্থল থেকে চলে যান। পরে পুলিশ হট্টগোলকারীদের কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারের দিকে সরিয়ে দেয়।
উদ্বেগ জানিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ : গণমাধ্যম দুটিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে গভীর উদ্বেগ, তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব), কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), ল রিপোর্টার্স ফোরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি), মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি), ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিক্যাব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা), বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল। জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিবৃতিতে বলা হয়, গণমাধ্যমে হামলা জুলাই বিপ্লবের চেতনার পরিপন্থি। একই সঙ্গে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীরের ওপর হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
হামলার ঘটনা ছিল পরিকল্পিত : প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয় এবং ছায়ানটে হামলার ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে মনে করছে নাগরিক সমাজ। এই হামলায় জড়িত অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে নাগরিক সমাবেশে তারা এ দাবি জানান। এর আগে তারা ডেইলি স্টার ও ছায়ানট ভবনের সামনেও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।
সমাবেশে অংশ নেন অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, আইনজীবী সারা হোসেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান, আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন, নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন, গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, তাসলিমা আখতার, চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন প্রমুখ।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে যে হামলা দেখা গেছে, তা ছিল পরিকল্পিত। এটি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার একটি জঘন্য প্রচেষ্টা মাত্র। এ ঘটনায় যুক্ত অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সব গণমাধ্যমকে এ ঘটনার প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নইলে এই প্রতিহিংসাপরায়ণতা কাউকে বেঁচে থাকতে দেবে না।’ প্রসঙ্গত, শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে সামিনা লুৎফা বলেন, এক সপ্তাহেও হামলাকারী গ্রেপ্তার না হওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক। এত দিনেও অপরাধীরা ধরা না পড়ায় এবং নানা ধরনের খামখেয়ালিপনা দেখা যাওয়ায় এর দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইছে নাগরিক সমাজ।
দুর্বৃত্তের গুলিতে আহত জুলাই অভ্যুত্থানের মুখ শরিফ ওসমান বিন হাদি বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে মধ্যরাতে প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। একই সময়ে আক্রান্ত হয় ডেইলি স্টার কার্যালয়ও। সেখানে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর। এ ছাড়া ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনেও ভাঙচুর চালানো হয়।
সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব, শুধু গণমাধ্যমে নয়, সর্বোপরি বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ : দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে সম্পাদক পরিষদ ও সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব (নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ)। গতকাল সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর ও নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদের সই করা বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ ও নিন্দা জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, এ হামলা শুধু গণমাধ্যমের ওপর নয়, এটা আমাদের সমাজের ওপর, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ। সর্বোপরি বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ। গভীর রাতের ওই হামলায় প্রতিষ্ঠান দুটির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও সম্পদহানির পাশাপাশি সংবাদকর্মীদের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। এটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায় এবং দায়িত্বহীনতারও স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।
সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব মনে করে, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শুরু থেকেই মব ভায়োলেন্স (সংগঠিত সহিংসতা) প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার যে ধারাবাহিকতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, সর্বশেষ ঘটনা তার আরেকটি ভয়াবহ উদাহরণ। গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা প্রমাণ করে যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব ছায়ানটে হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদও জানাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামকে ফোন করে নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন এবং পাশে আছেন বলে জানান। তবে এ হামলা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে। বিবৃতি বা আশ্বাস নয়, অবিলম্বে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারসহ সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীরকে হেনস্তার ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছে সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব। পেশাজীবী সংগঠন, ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য আহ্বান জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব।
