ফুলকি ডেস্ক : প্রকৃতির নীরব আখড়া—ডার্টমুর। খোলা তৃণভূমির ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, প্রাচীন শিলাস্তূপের গায়ে লেগে থাকা লাইকেন, ব্রোঞ্জ যুগের সমাধি আর পাথরের স্তম্ভ জানিয়ে দেয়, হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ এই এলাকার প্রতি আকৃষ্ট ছিল। যুক্তরাজ্যের অন্যতম সুন্দর ও মূল্যবান প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে বিবেচিত হয় এটি। এই এলাকাকে সাইট অব স্পেশাল সায়েন্টিফিক ইন্টারেস্ট (এসএসএসআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, কারণ এখানে বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব জীববৈচিত্র্য এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। একসময় যেসব পাখি এখানে প্রজনন করত—গোল্ডেন প্লভার, রেড গ্রাউস, রিং-উজেল—তারা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অথবা অবলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
যুক্তরাজ্যে বর্তমানে ১৫টি জাতীয় উদ্যান রয়েছে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ৭৫ বছর আগে জাতীয় উদ্যানগুলো তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এসব উদ্যানের সৌন্দর্যের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রকৃতি নিধনের গল্প। বহিরাবরণে শিলাময় এই অঞ্চলগুলোকে জীবন্ত ইকোসিস্টেম বলেই ভুল করা হয়। পরিবেশকর্মী গাই শ্রাবসল বলছেন, "‘আমরা পাথর দেখছি, অথচ যা থাকার কথা ছিল—জীবন্ত প্রাকৃতিক জগৎ—তা হারিয়ে গেছে।’
সম্প্রতি ন্যাচারাল ইংল্যান্ড ডার্টমুরের সবচেয়ে বড় তিনটি সংরক্ষিত এলাকার জরিপ করেছে। দেখা গেছে, এর মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ অনুকূল পরিবেশগত অবস্থায় আছে। ২০১৩ সালের পর থেকে ‘প্রতিকূল’ হিসেবে বিবেচিত এলাকার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
পরিবেশ কর্মী টনি হোয়াইটহেড বলছেন, ডার্টমুর এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এক সময়কার রঙিন হিথার গালিচা আজ নিঃশেষ প্রায়। এক ঘণ্টা হাঁটাপথে হেন টরের চূড়ায় পৌঁছে দেখা গেল, হিথারের গুচ্ছ খুঁজে পেতে হাঁটু গেড়ে ঘাসের ভেতর খোঁজ করতে হচ্ছে। বিলবেরির ঘন ঝোপের জায়গায় এখন মাত্র কয়েকটি ছোট ডাল দেখা যায়, তাও পাথরের কোণায় লেগে। একঘেয়ে ঘাস পুরো এলাকা ঢেকে রেখেছে, যা গরু-ছাগলের অতিগ্রাসনে কেবল টিকে আছে মাত্র।
নতুন জরিপে দেখা গেছে, ডার্টমুরে হিথার গাছপালা ২৫ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১ শতাংশে। গবেষকরা বলছেন, যদি এখনই কিছু না করা হয়, তাহলে এই হিথার একেবারে হারিয়ে যাবে।
এই অঞ্চলের বন্যপাখি যেমন রিং উজেল, কার্লিউ, ট্রি পাইপিট ও হুইনচ্যাট, যাদের জন্য এই বনভূমি শক্তিশালী আশ্রয়স্থল হওয়া উচিত ছিল, তারা আজ অত্যন্ত দুর্লভ। এর মূল কারণ—ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা।
জাতীয় উদ্যানের অধিকাংশ জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন, আর পাহাড়ি এলাকায় মূলত গবাদিপশু চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডার্টমুরের মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জমি সরকারিভাবে মালিকানাধীন। ফলে সংরক্ষণ নয়, বরং অর্থনৈতিক স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
২০২৪ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের জাতীয় উদ্যানে মাত্র ৬ শতাংশ জমিতে প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। অথচ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ জমি সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাস্তবে সংরক্ষিত জমির পরিমাণ ৩ শতাংশও নয়।
আর্থিক সংকট এই ব্যবস্থাকে আরো দুর্বল করেছে। ২০১০ সালের পর থেকে সরকারি অনুদান প্রকৃতপক্ষে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) বলছে, যুক্তরাজ্যের কোনো জাতীয় উদ্যানই আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতির যোগ্য নয়।
এই ব্যর্থতা এখন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওয়াইল্ড জাস্টিস নামের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন ডার্টমুর কমনার্স কাউন্সিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেছে। অভিযোগ, তারা পশু চারণের সীমা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিগত ১০ বছরে কোনো সীমাবদ্ধতামূলক নোটিসও জারি করেনি।
তবু আশার আলো কিছু জায়গায় জ্বলছে। গাড়ি পার্কের আশপাশে বা পাথরের ফাঁকে কিছু বুনো গুল্ম, ছোট হিথার গাছ বা ফলজ ঝোপ এখনো বেঁচে আছে। যেসব জায়গায় চারণ হয়নি, সেখানেই প্রকৃতি টিকে থাকার চেষ্টা করছে।