স্টাফ রিপোর্টার : ভূমিকম্প প্রস্তুতি সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের জরুরি বৈঠকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের পাঠানো লিখিত সুপারিশ নিয়ে সরকার দ্রুত সময়ে আলোচনা করে টাস্কফোর্স গঠন করবে বলে সোমবার বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
ভূমিকম্পের বিষয়ে আশু করণীয় নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্সে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা যুক্ত থাকবেন।
শুক্র ও শনিবার দুই দিনে চার দফা ভূমিকম্পে দেশে আতঙ্কিত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে তার দপ্তরে বৈঠকে বসেন।
তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই; বরং প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞদের আহ্বান জানান, তারা যেন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সরকারের করণীয় সম্পর্কে লিখিত পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, “আমরা হাত গুটিয়ে রাখতে চাই না, আবার অবৈজ্ঞানিক কোনো পদক্ষেপও নিতে চাই না। আপনাদের পরামর্শগুলো দ্রুত লিখিত আকারে আমাদের দিন; সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।”
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং এক বা একাধিক টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাওয়া মাত্রই সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
শনিবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার আগে শুক্রবার সকালে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্প আঘাত হানে বাংলাদেশে।
ওই ভূমিকম্পে তিন জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয় এবং ৬ শতাধিক মানুষ আহত হন। ঢাকার বহু ভবনে ফাটল দেখা দেয়, কোথাও কোথাও ভবন হেলে পড়ার ঘটনাও ঘটে।
রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদীতে, এবং এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে।
এই ভূমিকম্পের ঘটনা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “কয়দিন আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পে যাদের মৃত্যু হল, যারা আহত হলেন—এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এমনটি যেন আর না হয়, তার জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “আপনারা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, অভিজ্ঞতা ভাগ করেছেন। এই আতঙ্ক থেকে জনগণকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা প্রয়োজন, সরকারকে তা জানান। কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে, কোন কোন বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে—সব জানান। দুর্ঘটনা যেভাবেই আসুক, যেন আমরা যেন সকল পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারি।”
ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে কী ধরনের মহড়া প্রয়োজন হবে, সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রয়োজন মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, “পাশাপাশি ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কোন পর্যায়ে আছি সেটিও মূল্যায়ন করতে হবে।”
বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও ভূমিকম্প-বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও সমন্বয়ের পরামর্শ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদেরকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
“আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘শুভেচ্ছা’ নামে একটি অ্যাপ করেছি। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের সাথে যুক্ত হোন। অ্যাপটিতে আরও কী ধরনের ফিচার আনা যেতে পারে, সে বিষয়েও আমাদের পরামর্শ দিন।”
বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভূমিকম্পকে ঘিরে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে অনেক গুজব তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে—৪৮ ঘণ্টার মধ্যে… ১০ দিনের মধ্যে…এক মাসের মধ্যে…বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবে—এ ধরনের অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
তারা বলেন, ভূমিকম্প কখন হবে—কেউ বলতে পারে না। কোন অঞ্চলে কত বছরে কতগুলো ভূমিকম্প হয়েছে এবং তাদের মাত্রা কী ছিল, তা দেখে একটি সময়সীমা অনুমান করা যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট দিন-তারিখ-সময় বলা যায় না।
বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ভূমিকম্পের উৎস ও উৎপত্তিস্থল নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে—বাংলাদেশ ও এর আশেপাশে কতগুলো উৎপত্তিস্থল আছে এবং সেগুলোর কারণে কম্পনের মাত্রা কী হতে পারে তা নিরূপণ করতে হবে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ আমরা স্বল্প ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। তবে আমাদেরকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, জনসচেতনতা তৈরিতে তরুণদের কাজে লাগানো জরুরি।
“ইনডোরে, আউটডোরে, ব্যক্তি পর্যায়ে ও প্রতিষ্ঠানে—চার স্তরে করণীয় পরিকল্পনা তৈরি করে সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। তরুণদের কাজে লাগিয়ে ন্যাচারাল হ্যাজার্ড প্ল্যান ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নিলে সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবে।”
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-চুয়েটের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “মন্ত্রণালয় তাদের আওতাধীন স্থাপনাগুলোর মূল্যায়ন করতে পারে। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ—এসব খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্পবিষয়ক প্রোগ্রাম চালু করলে আতঙ্ক নয়, বরং সচেতনতা তৈরি হবে।”
মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-এমআইএসটির অধ্যাপক মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, করণীয় সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। মানুষকে মাথা ঠাণ্ডা রাখার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কোন এলাকায় খোলা জায়গা আছে, কোথায় জমায়েত হওয়া যায়—তা জানাতে হবে এবং সে অনুযায়ী মহড়া করতে হবে। বাসাবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহড়ার ব্যবস্থা জরুরি।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মো. খালেকুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যেই একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূমিকম্পের ফলে ফাটল ধরা ভবনের ছবি সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এর মধ্য থেকে দুইশটির বেশি ভবনের মূল্যায়ন করা হয়েছে। বেশিরভাগই বিভাজন দেয়ালে ফাটল দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “সফটওয়্যারটির মাধ্যমে দ্রুত ফাটল ধরা ভবনের মূল্যায়ন ও পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে।”
বৈঠকে উপদেষ্টাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আসিফ নজরুল, ফারুক ই আজম, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আলী রিয়াজ।
বিশেষজ্ঞ হিসেবে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক তাহমীদ মালিক আল-হুসাইনী, অধ্যাপক তানভীর মনজুর ও অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম; বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মমিনুল ইসলাম; আবহাওয়াবিদ মো. রুবাইয়্যাত কবীর; ভূতত্ত্ববিদ রেশাদ মো. ইকরাম আলী; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ মো. শাখাওয়াত হোসাইন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণতা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান খান।
