মঙ্গলবার, 25 নভেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

তাজরীনে প্রাণহানি: যুগ পার হলো, কবে শেষ হবে বিচার?


স্টাফ রিপোর্টার : সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনায় করা মামলার বিচার ১৩ বছরেও শেষ হয়নি, আর কবে নাগাদ শেষ হবে বলতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ।


ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের যেমন ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার আক্ষেপ রয়েছে, তেমনি আসামিদের আদালতে হাজিরা দেওয়ার ভোগান্তি আছে।
মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ নাসরিন জাহানের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে।


গত বছর তাজরীন ফ্যাশনসের ফিনিশিং সুপারভাইজার আমিনুর রহমান সাক্ষ্য দেন। এরপর আর কোনো সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
সবশেষ ১৮ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ছিল, তবে ওইদিন কোনো সাক্ষী আদালতে আসেননি। বিচারক আগামী বছরের ৯ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন।


রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুর রহমান বলছেন, “সাক্ষীদের প্রতি আদালত থেকে সমন ইস্যু করা হয়। সমন পৌঁছাতে পারেনি বা পায় না, কোনো কারণে হয়তো সাক্ষীরা তা পাচ্ছে না।”


২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে আশুলিয়ায় নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের মালিকানাধীন তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়; দুই শতাধিক শ্রমিক আহত ও দগ্ধ হন।


পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। নিহত ১১১ জনের মধ্যে তৃতীয় তলায় ৬৯ জন, চতুর্থ তলায় ২১ জন, পঞ্চম তলায় ১০ জন এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ১১ জন মারা যান। শনাক্ত করা ৫৮টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৫৩ লাশ অশনাক্ত অবস্থায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।


অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর ( দণ্ডবিধির ৩০৪ ক) ধারা যুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি এ মামলার তদন্ত শুরু করে।
ঘটনার পর শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, আগুন লাগার পরও কারখানার ছয়টি ফ্লোরের কয়েকটিতে দরজা আটকে রাখা হয়েছিল, শ্রমিকদের নিচে নামতে দেয়া হয়নি। এছাড়া ওই কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারত বিধি অনুসরণ না করা এবং অবহেলারও প্রমাণ পাওয়া যায়।


এরপর সে বছর ২২ ডিসেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তারসহ ১৩ জনকে আসামি করে পুলিশ যে অভিযোগপত্র দেয়, তাতে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়।
প্রথম ধারায় আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দ্বিতীয় ধারায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছর জেল হতে পারে।


২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান। পরে মামলাটি বিচারের জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে স্থানান্তর করা হয়। অভিযোগ গঠনের ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে।


এ মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যরা হলেন-কারখানার সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক ও কোয়ালিটি ম্যানেজার শহীদুজ্জামান দুলাল জামিনে আছেন।


এছাড়া স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, লোডার শামীম মিয়া, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর পলাতক।


এ মামলার বিচার বিষয়ে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুর রহমান বলেন, “মামলাটা ২০১২ সালের। আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা মামলাটিতে তেমন গুরুত্ব দেননি। একারণে মামলার বিচার আগায়নি।”


তিনি বলেন, “সাক্ষীদের আদালতে হাজির হতে সমন ইস্যু করা হচ্ছে। কিন্তু তারা আসছেন না। মামলার সাক্ষীও ১০৪ জন। এতো সাক্ষী শেষ করাও কঠিন। তারপরও আমরা সাক্ষী হাজির করে মামলার বিচার ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করবো।”


আসামিদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তারের আইনজীবী হেলেনা পারভীন বলেন, “মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সাক্ষীরা নিয়মিত আসছেন না। আসামিদের আদালতে হাজিরা দিয়ে যেতে হচ্ছে। আগুন লাগার ঘটনা একটা দুর্ঘটনা। মালিক হিসেবে তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এজন্য তাদের আসামি করা হয়েছে।”


তিনি বলেন, “দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনায়। তারপরও তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মামলায় যা হওয়ার তা তো হবে। ন্যায়বিচার চায়। আসামি করছি, ন্যায়বিচারে তারা খালাস পাবেন।”


অপর আসামি দুলাল, হামিদুল ও আল-আমিনের আইনজীবী রোকেয়া বেগম বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারছে না। এটা তাদের ব্যর্থতা। আসামিরা ‘সাফারার’ হচ্ছেন। তাদের তো নিয়মিত আদালতে হাজির হতে হচ্ছে।”


তিনি বলেন, “অনেক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও মাত্র ১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষীদের আদালতে আনা যাচ্ছিল না। এ কারণে আগের বিচারক মামলাটা ‘ক্লোজ’ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বদলি হয়ে যান। নতুন বিচারক এসেছেন। তিনি চেষ্টা করছেন। দেখা যাক কী হয়।”


এ আইনজীবী বলেন, “আসামিরা কর্মী। তারা আহত না হওয়ার কারণে আসামি হয়েছেন। এখানে অনেক কিছু হচ্ছে। মিথ্যা সাক্ষ্যও দেওয়া হচ্ছে। তাদের হয়রানি করতে আসামি করা হয়েছে। আদালতের প্রতি তাদের সম্মান আছে। আশা করছি, মামলার সুরাহা হবে। সঠিক বিচারে আমরা খালাস পাবো।”


তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডে আহত মাহফুজা বলেন, “এতো বছর হয়ে গেল, না পেলাম আর্থিক সহযোগিতা, না বিচার। আমরা বিচার চাই। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও। কারণ আমাদের অবস্থা এমন, কর্ম করে খাওয়ার ক্ষমতা নাই।”
 

 

সর্বাধিক পঠিত