স্টাফ রিপোর্টার : গত শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের বড় ঝাঁকুনির ভীতি এখনও গেঁথে আছে মানুষের মনে। ওই দুলুনির রেশ না কাটতেই গতকাল শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরও তিনবার কেঁপেছে দেশের বিভিন্ন এলাকা। আগের দিন ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী। আর শনিবার সকালের কম্পনের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর পলাশ; সন্ধ্যায় দুবারের একটি রাজধানীর বাড্ডা, আরেকটি নরসিংদীতেই। সব মিলিয়ে সাড়ে ৩১ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশে চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা অল্প সময়ে বারবার ভূমিকম্পে বড় বিপর্যয়ের আভাস দিচ্ছেন। তারা বলছেন, চারটি ভূমিকম্পই ‘ফোরশক’। বড় কম্পনের আগে প্লেটের ওপর চাপ বাড়তে থাকে, ছোট ছোট কম্পন সেই চাপের ইঙ্গিত। ভূঅভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। সামনে আরও কয়েক দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণে অবিলম্বে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
চার ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নরসিংদী ও ঢাকা
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মাধবদীতে, কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। স্থায়িত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড। এ ঘটনায় তিন জেলায় প্রাণ হারান অন্তত ১০ জন, আহত ছয় শতাধিক। ঢাকার বহু ভবনে ফাটল, কোথাও কোথাও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএসের মতে, শুক্রবার বাংলাদেশের সাত কোটির মতো মানুষ মৃদু বা হালকা ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন।
এরপর গতকাল শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে আরও একটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। এটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর পলাশ। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। একই দিন শনিবার সন্ধ্যায় পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়।
এটির উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানীর বাড্ডায়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩, উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে।
বড় বিপদের বার্তা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী সরকার বলেন, বড় ভূমিকম্পের আগে ৩০-৪০টি ছোট ছোট ভূমিকম্প হতে পারে। একই স্থানে বারবার কম্পন হলে বুঝতে হবে সামনে বড় বিপদ। সে বিষয়ে অপেক্ষা করতে হবে আরও চার-পাঁচ দিন। তারপর বোঝা যাবে কী হয়!
মেহেদী আহমেদ আনসারী ঢাকার পাশে বারবার ভূমিকম্পকে দেখছেন বড় ভূমিকম্পের লক্ষণ হিসেবে। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার কাছাকাছি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল অস্বাভাবিক বলা যাবে না। এর আগেও হয়েছে। বড় একটা ভূমিকম্প আসার কয়েক বছর আগে থেকে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্প যেখানে হবে, সেখানে না হয়ে অন্য জায়গা বা তার আশপাশে হয়। তুরস্কের বড় ভূমিকম্পের আগে ১০০টিরও বেশি ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়েছিল। গত এক বছরে বাংলাদেশে ৫০টিরও বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে।
বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলে আসছেন, দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশে পড়ায় এখানে বড় ভূকম্পনের ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া নদনদীর গতি পরিবর্তন হওয়ায় তা দেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পন হলে দুই থেকে তিন লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে। পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ অবরুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভেঙে পড়তে পারে ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ভূমিকম্প এড়ানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভবনের মান পরীক্ষা, ঝুঁকির ভিত্তিতে সেগুলোকে আলাদা করে ফেলা এবং নাগরিককে সতর্ক করার পাশাপাশি নিয়মিত মহড়ার আয়োজন করা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার কয়েক দশক ধরে ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশের ঝুঁকির বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, নরসিংদীতে ভূমিকম্পের কারণ ভূগর্ভে ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের অবস্থান বদল। তবে এর বাইরে অনেক জায়গায় সাব-প্লেট ক্রিয়াশীল আছে। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। বাংলাদেশে এমন কয়েকটি ফল্ট লাইন আছে। এই প্লেটগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে কিংবা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন এক ধরনের শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। ৮ দশমিক ২ মাত্রার যে শক্তি, সেটা কিন্তু এখনও জমা হয়ে আছে। যে কোনো সময় দেখা যাবে, এর চেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেছে।
ইউএসজিএস বলছে, শুক্রবার বাংলাদেশের যেখানে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে সেখানে ১৯৫০ সালের পর থেকে শুক্রবারের ভূমিকম্পের আগে ৫ দশমিক ৫ মাত্রা বা এর চেয়ে বড় আকারের ভূমিকম্প হয়েছে ১৪টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস দুটো। এর একটি ‘ডাউকি ফল্ট’, যা ভারতের শিলং মালভূমির পাদদেশে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ-জামালগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলে বিস্তৃত। এটি প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। আরেকটি সিলেট থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, টেকনাফ পর্যন্ত যা সব মিলিয়ে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই উৎসটিকে খুব ভয়ংকর বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এই অঞ্চলে গড়ে দেড়শ বছর পরপর ৭ মাত্রার এবং আড়াইশ থেকে তিনশ বছর পরপর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৭৬২ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ৭ থেকে সাড়ে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের নজির আছে। শেষ এক-দেড়শ বছরে এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হয়নি। এখন যে কোনো সময় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে; ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা এখন নেই। ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে একটা বড় ভূমিকম্প হবেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চলে ২৭টি ভূমিকম্প হয়েছে।
এর পর ২০২২ সালে ১৯টি, ২০২৩ সালে ৩৫টি, ২০২৪ সালে ৫৪টি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৯টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে ছিল সাতটি এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে উৎপত্তিস্থল ছিল দুটি। ২০২৪ সালে ১৩টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ। ২০২২ সালে কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশে ছিল না।
গত কয়েক বছরে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, সেগুলো ছিল ২ দশমিক ৮ থেকে ৬ মাত্রার। ঢাকা ও এর আশপাশে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থাকার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, তবে মাত্রা ছিল কম। এর মধ্যে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ ৪.৫ মাত্রা, ২০০৮ সালের ২৬ জুলাই ৪.৮ মাত্রা এবং ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওইসব ঘটনায় বড় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
ঐতিহাসিকভাবেও এ অঞ্চল বড় ভূমিকম্পের সাক্ষী। ১৮৯৭ সালের ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ (৮.০ মাত্রা) তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় এক হাজার পাঁচশর বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এ ছাড়া ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প (৭.৬ মাত্রা) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছিল।
অধ্যাপক আনসারী বলেন, এ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়েছে, সেটা ১৮৯৭ সালে। এমন ভূকম্পনের শঙ্কা আড়ইশ থেকে তিনশ বছর পর পর আসে।
বড় ঝুঁকিতে ঢাকা
বড় ধরনের যে কোনো ভূমিকম্পে ঢাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এখানে ভবন ও জনবসতি অনেক। দেশের উত্তর-পূর্ব ভাগকে ‘অধিক ঝুঁকিপূর্ণ’ ১ নম্বর অঞ্চল; মধ্যভাগের ২ নম্বর অঞ্চলকে ‘মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ’ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩ নম্বর অঞ্চলকে ‘কম ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপের ফল বলছে, ঢাকায় ৭ বা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে; ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন।
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলও বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ২০১১ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭৮ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। গত দেড় দশকে এই হার খুব একটা কমেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে ঢাকার ২১ লাখ ভবনের মান যাচাই করা অন্যতম কাজ এবং ‘রেড বিল্ডিং’ চিহ্নিত করা জরুরি। ভূমিকম্পের আগে সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রঙে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।
‘আফটার শক হচ্ছে, পুনরায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি’
অল্প সময়ে বারবার ভূমিকম্পকে ‘আফটার শক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) পরিচালক মো. মমিনুল ইসলাম। গতকাল রাতে তিনি জানান, ভূমিকম্পের পরের ৭২ ঘণ্টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শুক্রবার যে ৫.৭ মাত্রার বড় ধরনের ভূমিকম্প হলো, সেটার পর তিনটি কম্পন আফটার শক। সাধারণত আফটার শকে আগের মাত্রার চেয়ে অন্তত ১ পয়েন্ট কম মাত্রা হয়। তাই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এমন আফটার শক ঘটতে পারে। আতঙ্কিত না হয়ে শকের সময় নিরাপদে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, শুক্রবারের মাত্রা ৬-এর নিচে হলেও ওয়েভ (কম্পন) বেশি সময় স্থায়ী এবং ঝাঁকি বেশি হওয়ার কারণ আমাদের এই অঞ্চলের মাটির গঠন কিছুটা দুর্বল। অপেক্ষাকৃত মাটির গঠন দুর্বল হলে শক বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়।
