স্টাফ রিপোর্টার : যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তি শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য অস্বস্তি ডেকে এনেছে। নতুন শুল্ক কাঠামো কার্যকর হওয়ার আগেই বেশ কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি আদেশ স্থগিত করেছে। রপ্তানি আদেশের আলোচনাও প্রায় বন্ধ। উপরন্তু বাড়তি শুল্কভার ভাগাভাগি করে নিতে চাপ দিয়েছে কোনো কোনো ক্রেতা। তবে ব্র্যান্ড ক্রেতাদের এসব পদক্ষেপের চেয়ে প্রতিযোগী দেশের পণ্যে বাংলাদেশের তুলনায় কম শুল্ক আরোপই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। রপ্তানিকারকরা বলছেন, নতুন শুল্কহার কার্যকর হলে ভারতের কাছে এ মর্যাদা হারানোর শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশকে টপকে তৃতীয় স্থানে চলে আসতে পারে ভারত। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের আরও বড় ব্যবধান তৈরি হতে পারে। নতুন কাঠামোতে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে বাংলাদেশের তুলনায় এ দেশ দুটির শুল্কভার কম। বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারে প্রধান রপ্তানিকারক চীনও।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘চুক্তির সুবাদে ভিয়েতনামের পণ্য বাংলাদেশের পণ্যের চেয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত এগিয়ে থাকবে। এত বড় ব্যবধান কোনোভাবেই ঘোচানো সম্ভব হবে না। আমাদের তুলনায় তারা অনেক এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে ভারত এবং পাকিস্তানের বেলায় কী হারে শুল্ক আরোপ হয়, সেটাও দেখার বিষয়। প্রতিযোগিতার তৎপরতার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগে আমরা বারবার অনুরোধ করে আসছি।’
গত সপ্তাহে দুই দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের পণ্যে এ যাত্রায় ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে। আগামী ১ আগস্ট থেকে যা কার্যকর হওয়ার কথা। এ হার বিদ্যমান হারের অতিরিক্ত। এতে মোট শুল্ক দাঁড়াবে অন্তত ৫১ শতাংশ। গত মাসে সব দেশের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ বাদ না গেলে শুল্ক ৬১ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। ঘোষণা দুটির কোনোটিতে বাংলাদেশের মূল প্রতিযোগী চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের নাম নেই। উপরন্তু চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী, ভিয়েতনাম এবং ভারতের শুল্কভার ২০ শতাংশের মধ্যেই থাকছে। চুক্তির ফলে চীনের পণ্যের শুল্ক ৯০ শতাংশ কমছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি এখন অসম প্রতিযোগিতার মুখে। দেশটিতে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে যেতে পারে বাংলাদেশের।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বরবারের মতো শীর্ষে রয়েছে চীন। গত বছর দেশটির রপ্তানির পরিমাণ এক হাজার ৬৫১ কোটি ডলার। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণ এক হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ৭৩৪ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে ভারতের অবস্থান চতুর্থ। গত বছর দেশটির পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৬৯ কোটি ডলার। পঞ্চম অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ার পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৪৩০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ ১০ দেশের বাকি দেশগুলো যথাক্রমে কম্বোডিয়া, মেক্সিকো, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া। অটেক্সার উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে এ প্রবণতা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন সম্প্রতি একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির বিস্তারিত এখনও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী, চীন বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের হার কমাতে পারে। বর্তমান শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
কয়েক দফা আলোচনার পর গত ৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামের মধ্যে নতুন বাণিজ্য চুক্তি সই হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এ ঘোষণা দেন। এই চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। ফলে বাংলাদেশের সমজাতীয় ভিয়েতনামের পোশাকে শুল্ক দাঁড়াবে ৩৬ শতাংশ। গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক কাঠামো অনুযায়ী ভিয়েতনামের পণ্যে ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ছিল। সে তুলনায় পরিবর্তিত শুল্কহার অনেক কম।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একটি অন্তর্বর্তী বাণিজ্য চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের পণ্যে শুল্কের হার ২০ শতাংশের নিচে নামতে পারে। এ ছাড়া চুক্তির আওতায় দুই দেশ নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য অনুকূল করতে চলমান আলোচনা অব্যাহত রাখার সুযোগ পাবে। চূড়ান্ত চুক্তির আগে ভারত অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির সুযোগ পাবে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভারত। গত ২ এপ্রিল ট্রাম্প প্রথম যে পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করেন, সেখানে ভারতের শুল্কহার নির্ধারণ করা হয় ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া চূড়ান্ত চুক্তির অংশ হিসেবে উভয় পক্ষের মধ্যে শুল্কহার নিয়ে আলোচনার পথ খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। এতে আগামীতে শুল্কহার আরও কমলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।