স্টাফ রিপোর্টার : গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে দ্বিধান্বিত বিএনপি। গণভোটের প্রশ্নের চার বিষয়বস্তুর মধ্যে কোনো এক বা একাধিক প্রশ্নে দ্বিমত থাকলে ভোটার কীভাবে মতামত জানাবে, তা পরিষ্কার নয় বিএনপির কাছে। এ অবস্থায় যেসব বিষয়ে জুলাই সনদে ঐকমত্য হয়েছে, সেসব বিষয়ে গণভোট আয়োজনের জন্য শিগগিরই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে আলোচনায় এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন গণভোট আয়োজনে বিএনপি সাধুবাদ জানালেও গণভোটের বিষয়বস্তু নিয়ে দলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একদিকে সরাসরি বিরোধিতা করতে পারছে না, অন্যদিকে এর সমর্থনও করতে পারছে না। বিরোধিতা করলে জামায়াতসহ অন্য বেশ কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচন পেছানোর কৌশল নিতে পারে। আবার জনগণের সামনে ইমেজ সংকটে ফেলার প্রচেষ্টাও হতে পারে। অন্যদিকে গণভোটে সমর্থন দিলে আগামীতে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র পরিচালনায় নানা জটিলতায় পড়তে পারে দলটি। এটিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে অনেকটা ক্ষমতাশূন্য করার প্রক্রিয়াও মনে করছেন দলের কেউ কেউ। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ‘হ্যাঁ’ নাকি ‘না’ ভোটের পক্ষে প্রচারে নামবে, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
দলটির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদকেই তারা মানদণ্ড হিসেবে নিয়েছেন। এর বাইরে তারা অন্য কিছু ভাবছেন না।
নেতারা জানান, গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের পর রাতে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে সাধুবাদ জানানো হলেও গণভোট নিয়ে কৌশলী অবস্থান নেওয়া হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ভাষণের পর সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারপ্রধানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের ওপর জনগণের সম্মতি গ্রহণের জন্য গণভোট অনুষ্ঠান এবং শিগগিরই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি স্থায়ী কমিটি আহ্বান জানাচ্ছে।
তবে বিএনপি নেতারা এখন প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত গণভোটের চার প্রশ্ন এড়িয়ে সই করা জুলাই সনদকে সামনে আনছেন। তারা দাবি তুলছেন, সংসদ নির্বাচনের দিনে যে গণভোট হবে, সেটি হতে হবে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের ওপর।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দিয়েছে। সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাব নিয়ে গণভোট হবে। প্রস্তাবগুলোকে চারটি বিষয়ে ভাগ করে একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধি নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এই প্রতিনিধিরা একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদ তার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।
যদিও সংবিধান সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাবগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে বিএনপি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), ন্যায়পাল, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়েছে। তবে গণভোটের প্রথম প্রশ্নে এসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ না রেখে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নে দুই কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদে পিআর এবং উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদনে সংবিধান সংশোধনের বিধানেও বিএনপির আপত্তি ছিল। কিন্তু গণভোটে এটাকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে পৃথকভাবে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
গণভোটের প্রশ্নের তৃতীয় ও চতুর্থ বিষয়বস্তু নিয়ে তেমন আপত্তি নেই দলটির। এর মধ্যে সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে এবং জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করার বিষয় রয়েছে। তবে গণভোটের প্রশ্নের প্রথম দুই বিষয়বস্তু নিয়ে জোর আপত্তি বিএনপির। এই দুই বিষয়বস্তু পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাবে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, আমরা স্বাক্ষরিত জুলাই সনদকেই রাষ্ট্র সংস্কারের ভিত্তি হিসেবে দেখছি। সেখানে গণভোটে যেসব বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে, যেসব বিষয়ে গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। সেসব বিষয়ের সঙ্গে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থা থাকলে, তা পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবে ক্ষুণ্ন হোক, তা আমরা চাই না। তাই আমরা কোনো আরোপিত আইন দিয়ে, আদেশ দিয়ে, কোনো জবরদস্তিমূলক প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করতে দিতে চাই না। স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের বাইরে জবরদস্তিমূলক কোনো প্রস্তাব যদি দেওয়া হয়, সেটি জনগণ গ্রহণ করবে না।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গণভোটের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন হয়ে যাবে না, সংবিধানও সংশোধন হয়ে যাবে না। তার জন্য অবশ্যই একটি নির্বাচিত সংসদ গঠিত হতে হবে।
গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট, নাকি ‘না’ ভোটে বিএনপির অবস্থান থাকবে– এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা সই করা জুলাই সনদের মধ্যেই থাকব। এর বাইরে যাব না।
বিএনপি নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট, নাকি আগে– এই প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতবিরোধ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ তীব্র হয়ে ওঠে। গণভোট আগে হোক, সেটি বিএনপি কোনোভাবেই চায়নি। ফলে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা থাকায় বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থান পেয়েছে। কিন্তু গণভোটের প্রশ্নের বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের মনে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় বিএনপির দ্বিমত ছিল। সেসব স্থানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে দলটি। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশে সেই ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সুবিধা রাখা হয়নি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ দলটি নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছে– সই করা জুলাই সনদের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দলের মান্য করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গণভোটের প্রশ্নের মধ্যে যে চারটি বিষয়বস্তু রাখা হয়েছে, সেখানে অসম্মতির সুযোগ নেই। মানুষ যদি একমত না হয়, সেই মতামত কীভাবে দেবে– তার উল্লেখ নেই। এতে নাগরিকদের প্রকৃত মতামত জানানোর পথ রুদ্ধ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারে, সেভাবে প্রশ্নগুলো সাজানো উচিত ছিল।
রিজভী বলেন, গোঁজামিল দিয়ে কোনো কিছু করা হলে তা টেকসই হবে না। গণভোটের উদ্দেশ্য কী, ৯০ ভাগ লোক যদি তা বুঝতে না পারে, তাহলে মানুষ সে তিমিরেই থেকে যাবে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে– সেই আলোকে গণভোটের প্রশ্নমালা করার পরামর্শ দেন এই নেতা।
