স্টাফ রিপোর্টার : সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনে একই সঙ্গে গণভোট করার সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, এখন তাদের আগের পরিকল্পনায় গণভোটের প্রস্তুতিও সমন্বয় করতে হবে।
প্রায় ৩৪ বছর পর আরেকটি গণভোট এবং দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক দিনে একসঙ্গে দুটো ভোট করতে হবে। এছাড়া এবারই প্রথম পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের ভোটগ্রহণ হবে।
দেশের প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের সঙ্গে প্রবাসের লাখ দশেক ভোটারকে নিয়ে এ নির্বাচন হবে। ফলে এই কর্মযজ্ঞ সামলাতে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে নির্বাচন কমিশনকে সেটি সামনে এসেছে।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে বলেছে, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে গণভোট নেওয়ার বিষয়টি এলে তাদের পরিকল্পনায়ও সমন্বয় আনতে হবে।
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে এ নির্বাচনের আয়োজনের সময় রাখা হয়েছে, যার তফসিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন।
দেশে ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিনটি গণভোট হয়েছে। তবে কখন জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হয়নি।
বিগত দুটি গণভোটে সম্পৃক্ত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের এমন দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে ভোটকক্ষ বাড়ানো, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর ভোটার সংখ্যা অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ সরঞ্জাম বাড়াতে হবে গণভোটে। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের বিষয়টিও রয়েছে।
সংসদ নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে ব্যাপক প্রচার থাকবে প্রার্থীদের, আর গণভোট নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর বিষয় রয়েছে।
তারা বলছেন, দুই ভোট একসঙ্গে নিলে ব্যয় ২০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।
গণভোট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি ও বিধি প্রণয়ণের পরই সার্বিক বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যাবে বলেছেন তারা।
এবার সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রায় ২৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। গণভোট আলাদাভাবে করলে এই ব্যয় ধারণা করা হয়েছিল। এখন সংসদ ও গণভোট একসঙ্গে করলে ব্যয় সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
একই দিনে সংসদ ও গণভোট হলে তার ব্যবস্থপনার বিষয়টি যেমন রয়েছে, তেমনি গণনার ক্ষেত্রে কোনটি আগে, কীভাবে করবে, তা নির্ধারণের বিষয়ও রয়েছে। আর গণভোটের ফলাফল গণনার সময় লাগবে বেশি।
বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আমরা সকল বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে।”
একই দিনে দুই ভোট করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “তাতে নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।”
সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশন-ইসির চ্যালেঞ্জসহ সার্বিক বিষয়ে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসবে নিজেদের মধ্যে আলোচনার পরে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে দুই ভোট একসঙ্গে করার সিদ্ধান্ত জানানোর পর বিকালে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জেনে, কমিশন বৈঠকে আলোচনা করে এ নিয়ে মতামত দেবেন।
দ্বিগুণ কর্মযজ্ঞের ভোট, ইসির চ্যালেঞ্জ
ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে ইসির।
সংসদ নির্বাচনের জন্য পৌনে ১৩ কোটি ভোটার ও প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার বিবেচনায় রেখে ব্যালট পেপার মুদ্রণের পরিকল্পনা করেছে ইসি।
প্রায় ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষ থাকবে। ৯ থেকে ১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ থেকে ৮ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবে ভোটে।
ইসির নির্দেশনায় রিটার্নিং অফিসারের তত্ত্বাবধানে ৩০০ আসনে সার্বিক নির্বাচন পরিচালনা করা হয়।
ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষ ধাপের সংলাপ চলছে।
সংসদ নির্বাচনের আগে একপক্ষ গণভোট চায় আর সংসদ নির্বাচনের দিনই আরেক পক্ষ গণভোট চায়, এমন মতবিরোধ চলে অনেকদিন।
দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্বের মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে ঘোষণা এল একই দিনে হবে দুই ভোট।
এমন পরিস্থিতির জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি কতটুকু, তার আভাস ছিল ২০ অক্টোবরের আইনশৃঙ্খলা সভায়। সেদিন বৈঠকে আমন্ত্রিতদের উদ্দেশে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, জুলাই সনদ অনুযায়ী গণভোট করতে গেলে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। বিষয়টি সমন্বয় করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।
সবশেষ বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ যখন প্রচার হচ্ছিল, তখন সিইসিহ নির্বাচন কমিশনাররা ছিলেন দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে।
সংলাপের শেষাংশে সাংবাদিকরা সিইসির কাছে বার্তা পাঠিয়ে একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করলে নির্বাচনে প্রভাব পড়বে কি না, চ্যালেঞ্জিং হবে কি না, সে প্রশ্ন তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনের মত জানতে চান।
তখন সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো জানলে, তখন আমরা ‘এক্সেরসাইজ’ করে, আমরা সব বসে, কমিশনে আলাপ আলোচনা করে একটা মতামত দিতে পারব। এ বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো মতামত দেওয়া যথার্থ হবে না।”
জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি তুলে ধরে এ সংলাপে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আজকে একটা গণভোটের ইস্যু আসলো, সেটাও কিন্তু আমাদের মাথায় আনতে হয়েছে কয়েকদিন আগে থেকে। সব কিছু মিলে আমার প্রথম দরকার ছিল রাজনীতিবিদদের সাথে বসা।
এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছি না। ইসি আশাবাদী, রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রার্থীরা সহযোগিতা করলে সুন্দর নির্বাচন সম্ভব।”
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “অনেকে সংলাপে তফসিল কবে, ঘোষণা কবে, তারিখটা যেন আমরা বলি। আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যটা শুনিনি। আমরা শুনে পরে (প্রতিক্রিয়া), মনে হয় সময় এসেছে এটা ঘোষণা করার। সেটা ইনশাহআল্লাহ আমরা দেখব।”
পরে সন্ধ্যায় তারা নিজেরা বসেন নির্বাচন ভবনে।
কাজ বাড়বে, গণনায় ঢের সময় লাগবে
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলছেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানোর পাশাপাশি গণভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভালো প্রশিক্ষণের বিষয় রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।
১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোটে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, “একদিনে সংসদ ও গণভোটের ক্ষেত্রে ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়। আমার ধারণা, কেন্দ্র না বাড়ালেও চলবে, আমার মনে হয়।
“ব্যালট পেপার গণনার সময় দুই সেট লোকবল লাগবে। এক সেট সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা করবে, আরেকট সেট ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ ভোট গণনা করবেন।”
প্রশিক্ষণের বিষয়ে সাবেক এই ইসি কর্মকর্তা বলেন, গণভোটের ব্যালট পেপার কীভাবে ইস্যু করবে, যারা গণনা করবে, তারা কীভাবে করবে সে বিষয়গুলো আছে।
জেসমিন টুলী বলেন, “প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের যখন প্রশিক্ষণ দেবে, একই সময়ে আরও দুটি সেশন বাড়িয়ে দিয়ে হয়ত গণভোটের প্রশিক্ষণটি করবে। গণভোটের ব্যয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে সার্বিকভাবে। প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটেও দুটি ব্যালট ইস্যু করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ নয়, বরং এ কাজগুলো করতে হবে সামনে।”
ফেব্রুয়ারিতে দিন ছোট হওয়ায় ভোটের সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, “সন্ধ্যার পরে নির্বাচন নেওয়ায় ঝুঁকি রয়েছে; অনেক জায়গায় বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে সকাল ৮টা বিকাল ৪টায় হয়ে যাবে। বয়োবৃদ্ধদের একটু সময় লাগে। ব্যালট বাক্স যেহেতু আলাদা হবে।”
প্রিজাইডিং অফিসার বাড়ানো ও সক্ষমতা বাড়ানো গেলে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না বলে মনে করেন জেসমিন টুলী।
গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপক প্রচার লাগবে বলেও মনে করেন তিনি।
“ভোটারদের আগে থেকে জানানো কেমন প্রশ্ন থাকে, বিশেষ করে গ্রামের দিকে বয়োবৃদ্ধ, নিরক্ষর মানুষদের একটু সময় লাগবে। আদেশের আলোকে গণভোট সংক্রান্ত আইন বা অধ্যাদেশ, বিধি সব হবে,” বলেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী।
১৯৭৭ সালে প্রথম গণভোটের সময় ছিল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা। আট ঘণ্টা টানা চলে ভোটগ্রহণ।
বর্তমানে ভোটের সময় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা।
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটগ্রহণের সময় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখছে না সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে আইন সংশোধনের বিষয় থাকবে।
প্রথম গণভোটের সময় ফল ঘোষণা করতে ৩০ ঘণ্টা সময় লেগেছিল।
ইসির সাবেক কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “সংসদ ও গণভোট একসঙ্গে হলে, ইতিবাচক দিক হল ভোটার উপস্থিতি। গণভোটে তো ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না; প্রার্থীরা ভোটার স্লিপ দেয় না। এখন দুই ভোট একদিনে হলে, একটা ভালো (সংখ্যক) ভোটার কেন্দ্রে যাবে। যারা জাতীয় সংসদে ভোট দেবে তারা কেন্দ্রে যাবে, সাথে গণভোটও দেবে।”
ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হলে কেন্দ্র বন্ধ, প্রয়োজনে পুরো আসনের ভোট বন্ধের বিধান রয়েছে সংসদে।
গণভোটের ক্ষেত্রে কীভাবে আইনি বিষয়গুলো গণভোট অধ্যাদেশ, বিধিতে থাকবে? জবাবে তিনি বলেন, দুটো আইন-বিধি একদিনে সমন্বয় করার বিষয়টি রয়েছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একজন ভোটারের একসঙ্গে তিন ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় সংসদ ও গণভাট এক দিনে দেওয়ায় কোনো ঝামেলা দেখছেন না সাবেক এই ইসি কর্মকর্তা।
“স্থানীয় নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য-তিন ভোট দেওয়ার চর্চা রয়েছে। দুটো ভোট দেওয়ায় ঝামেলা নেই। তবে প্রচার সংসদের দিকে যাবে বেশি, প্রার্থীরা সক্রিয় থাকে। ব্যালট বাক্স বাড়াতে হবে, ভোটের সময় না বাড়ালেও চৌহদ্দির মধ্যে থাকলে তো ভোট নিতে হবে। ভোট ব্যবস্থাপনার বিষয় রয়েছে।”
সংসদ নির্বাচনের পাশপাশি গণভোটের ফলাফল গণনা বিলম্ব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
মিহির সারওয়ার বলেন, “ভোট গণনার সময়টা অনেক বেশি লাগবে। এজন্য গণনার সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা দরকার হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হবে, ভোট কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং ‘মডেল টেস্ট’ করতে পারলে ভালো।”
সাবেক এই ইসি কর্মকর্তা বলেন, গণনার সময় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের আগে গোনা হবে নাকি, গণভোটের ব্যালট পেপার আগে করবে-কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে। প্রথমবারের মতো দুটো নির্বাচন একসঙ্গে হওয়ায় কীভাবে কী কাজ করলে সহজভাবে হবে, নির্বাচন কমিশনকে কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।
