স্টাফ রিপোর্টার : জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়নি। উল্টো নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকা দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ জারির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া সরকারের সাত দিন শেষ হয়েছে গতকাল রোববার। বিএনপি বলছে, সংস্কার ও গণভোট চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবিতে আন্দোলনে যাচ্ছে। আগামীকাল মঙ্গলবার ঢাকায় বড় শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছে। আর বিরোধ নিরসনে সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
সরকারের সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি খসড়া আদেশ চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। সমঝোতা না হওয়ায় সরকারই ঠিক করবে আদেশে কী কী থাকবে। আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তা উত্থাপন করা হতে পারে। গণভোট কখন হবে– এ সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
খসড়া চূড়ান্ত করার দায়িত্বে থাকা আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। একাধিক উপদেষ্টা বলেছেন, গোপনীয়তায় আদেশ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। উপদেষ্টারাও জানেন না, এতে কী কী থাকছে।
গত ৩০ অক্টোবরের বৈঠকে অধিকাংশ উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটে মতামত দেন। তবে ৩ নভেম্বর পরিষদের জরুরি বৈঠকে একাধিক উপদেষ্টা ভিন্নমত জানান। এ বৈঠক থেকেই দলগুলোকে সমঝোতার জন্য সাত দিন দেওয়া হয়।
সময়সীমা শেষ হওয়ায় এখন কী হবে– প্রশ্নে এক উপদেষ্টা সমকালকে বলেছেন, আমরা ১৩ নভেম্বরের উপদেষ্টা পরিষদের পরবর্তী বৈঠক পর্যন্ত দেখতে চাই। ততদিনে সমঝোতা না হলে সরকারই সিদ্ধান্ত দেবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। এ মাসের মাঝামাঝি আদেশ জারি হবে।
এখন গণভোট নিয়েই প্রশ্ন বিএনপির
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে বিএনপি রাজি হলেও এখন গণভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। কমিশন সংস্কারের জন্য ছয়টি পদ্ধতি প্রস্তাব করে রাজনৈতিক দলের মতামত চেয়েছিল। এর দুটি ছিল নির্বাচনের আগে গণভোট এবং নির্বাচনের দিন গণভোট। বিএনপি তখন গণভোটের বিরোধিতা করে। জামায়াত মতামত দেয়নি। তবে সংলাপ শুরুর পর জামায়াত গণভোট দাবি করে।
গত জুনে ২২ মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সব দলের সঙ্গে একত্রে সংলাপ শুরু করে কমিশন। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতিসহ কয়েকটিতে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিলেও, কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ঐকমত্য ঘোষণা করে। ঐকমত্য না হওয়ায় জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল আবার গণভোটের দাবি তোলে। বিএনপি তখন বিরোধিতা করলেও গত ১৭ সেপ্টেম্বর গণভোটে রাজির কথা জানায়। এর পর ৫ অক্টোবর নির্বাচনের দিনই গণভোট চায়।
গত ১৭ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সই করা জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে। সইয়ের আগের দিন বিএনপির দাবিতে সনদে নোট অব ডিসেন্ট যুক্ত করা হয়। তবে গত ২৮ অক্টোবর কমিশন সুপারিশে আদেশের যে খসড়া দিয়েছে, তাতে নোট অব ডিসেন্ট নেই। সুপারিশ করা হয়েছে, গণভোট হবে আদেশ এবং তপশিলে যুক্ত সংস্কারের ৪৮ প্রস্তাবের ওপর।
এখন এর বিরোধিতা করে বিএনপি গণভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। বিদ্যমান সংবিধানে গণভোট করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সংবিধানের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সংবিধানে গণভোটের বিধান নেই। এখন গণভোট নির্বাচনের আগে কেন, ভোটের দিন করাও এ সংবিধান গ্রহণ করবে না। সুতরাং আমাকে সংবিধান মানতে হবে।
এদিকে গতকাল ঠাকুরগাঁওয়ে কর্মসূচিতে উপস্থিত নেতাকর্মীকে প্রশ্ন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আপনারা কি গণভোট, সনদ এসব বোঝেন? এসব বোঝেন শিক্ষিত কিছু ওপরতলার লোক। যারা আমেরিকা থেকে এসে এসব আমাদের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন, আমরাও মেনে নিয়েছি। সংস্কার প্রস্তাবে আমরা যেটিতে রাজি, সেটি বাস্তবায়িত হবে। যেটিতে রাজি হবো না, সেটি সংসদে যাবে। সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, এরপর পাস হবে।
আন্দোলনে জামায়াত
নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আট দল মঙ্গলবার রাজধানীতে জনসমর্থন দেখানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। গতকাল মগবাজারের দলীয় কার্যালয়ে জনসভার প্রস্তুতি সভা করে জামায়াত। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের সভাপতিত্বে সভায় মহানগর জামায়াত-শিবিরের নেতারা ছিলেন।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেছেন, সরকার সোমবারের মধ্যে আদেশ জারি না করলে মঙ্গলবার ঢাকায় জনসভা হবে। মানুষ জানিয়ে দেবে তারা গণভোট কখন চায়। নির্বাচনের আগেই গণভোট হতে হবে।
যুগপৎ আন্দোলনের আট দল পৃথকভাবে কর্মসূচি দিলেও মঙ্গলবারের জনসভা একসঙ্গে করবে। আজ ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে আট দলের নেতারা বৈঠকে বসবেন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, নির্বাচনের আগে গণভোটসহ ৫ দাবির কর্মসূচি নির্ধারণে।
সরকারের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত চায় এনসিপি
বিলুপ্ত ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বলা নেই, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ কে জারি করবে ও গণভোট কখন হবে। এ দুই সিদ্ধান্ত তারা সরকারের ওপর দিয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, গণভোট হবে আদেশের ওপর। গণভোটে তা অনুমোদিত হলে আগামী নির্বাচনে দ্বৈত ভূমিকার সংসদ গঠন হবে। সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত কনস্টিটুয়েন্ট ক্ষমতার ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ সনদ বাস্তবায়ন করবে।
কমিশনের আদেশের প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি সংবিধান সংশোধনের বিল পাস বলে গণ্য হবে। গণভোট হবে আদেশ এবং সংবিধান সংশোধনের বিলের ওপর। দ্বিতীয় খসড়ায় বলা হয়েছে, গণভোট হবে আদেশ এবং তপশিলে যুক্ত সংস্কারের ৪৮টি প্রস্তাবের ওপর।
একাধিক উপদেষ্টা এবং ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা সমকালকে জানিয়েছেন, সরকার দ্বিতীয় খসড়া গ্রহণ করতে পারে। ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। আর কিছু ছাড় থাকবে বিএনপির দাবিতে। তবে অন্য দলগুলোকে সন্তুষ্ট করতে এবারের নির্বাচন থেকে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিধান রাখা হতে পারে। যদিও তা শেষ পর্যন্ত থাকবে না কিনা– নির্ভর করছে প্রধান উপদেষ্টার ওপর।
সরকারের এমন ভূমিকার সমালোচনা করেছে সনদে সই না করা এনসিপি। দলটি বলছে, উপদেষ্টারা এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, যে ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার ক্ষমতায়, এর অন্যথা করা যাবে না। জনগণের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
