বুধবার, 26 নভেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

সাভারে ‘অর্গানিক খাদ্য পণ্য ও কৃষি পণ্য প্রদর্শনী মেলা’র নামে জুয়া খেলা হচ্ছে | dailyfulki


স্টাফ রিপোর্টার : সাভার পৌর ভবনের ঠিক পিছনে গেন্ডা এলাকায় ইমু সাহেবের বালুর মাঠে মাসব্যাপী ‘অর্গানিক খাদ্য পণ্য, কৃষি পণ্য প্রদর্শনী ও শিল্প বাণিজ্য মেলা-২০২৫-এর নামে কৌশলে জুয়া খেলা চলছে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের অনুমতিতে মেলাটি আয়োজনের কথা বলা হলেও সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অনুমতি পত্রের ১১টি শর্তাবলি কোথাও মানা হয়নি। মেলায় অর্গানিক খাদ্য ও কৃষি পণ্যের মাত্র একটি স্টল রয়েছে। জানা গেছে, আয়োজক কর্তৃপক্ষ লোক দেখানোর জন্য এ স্টলটি দৈনিক ভাড়া পরিশোধের চুক্তিতে বসিয়েছে। 


মেলায় অর্গানিক খাদ্য ও কৃষি পণ্যের পরিবর্তে নিম্নমানের খাদ্য, পোশাক, বিনোদনমূলক গেমস ও সন্দেহজনক স্টলের আধিক্য লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও আবাসিক এলাকায় মেলা চলায় উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর কারণে আশপাশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এতে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তারা অবিলম্বে আবাসিক এলাকায় মেলার নামে জুয়া খেলা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়েছেন।


অর্গানিক খাদ্য পণ্য, কৃষি পণ্য প্রদর্শনী ও শিল্প বাণিজ্য মেলার আয়োজক বাংলাদেশ অর্গানিক ফারমার্স এন্ড রিটেলার্স এসোসিয়েশনের (বোফারা) সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম তুষার ও যুগ্মসাধারণ সম্পাদক শরীফ মো: বেদুইন হায়দার লিও’র সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।    

 

এ ব্যাপারে সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। সহকারি কমিশনার (ভূমি) সাভার সার্কেল আবদুল্লাহ আল আমিনকে বিষয়টি তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছি। তার রিপোর্টের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।


এ ব্যাপারে সহকারি কমিশনার (ভূমি) সাভার সার্কেল আবদুল্লাহ আল আমিনের কাছে জানাতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে দেখেছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিবো। এর বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না।


তবে সহকারি কমিশনার (ভূমি) সাভার সার্কেলের অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ্যাসিল্যান্ড আবদুল্লাহ আল আমিন পরপর দুইদিন ছদ্মভেসে গেন্ডা এলাকায় ইমু সাহেবের বালুর মাঠে মাসব্যাপী ‘অর্গানিক খাদ্য পণ্য, কৃষি পণ্য প্রদর্শনী ও শিল্প বাণিজ্য মেলা-২০২৫ পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনের সময় তিনি মাত্র একটি অর্গানিক খাদ্য পণ্যের স্টাল দেখতে পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি মেলাস্থলে বিভিন্ন অনিয়ম দেখেছেন।
 

অর্গানিক পণ্যের বদলে নিম্নমানের পণ্য :


দৈনিক ফুলকি প্রতিবেদক সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন, মেলায় ‘জনতার বাজার’ নামে কৃষি উপকরণ ও খাদ্য পণ্য বিক্রির একটি ছোট স্টল থাকলেও, মূল আয়োজন জুড়ে রয়েছে দুটি বড় পোশাকের স্টল, দুটি আচারের স্টল, একটি ইলেকট্রনিক্স স্টল এবং নানা প্রকারের ফুচকা-চটপটি, ঝালমুড়ি ও নিম্নমানের খাবারের দোকান।


মেলায় কোথাও কৃষি পণ্য প্রদর্শনী বা কোনো শিক্ষামূলক কার্যক্রমের অস্তিত্ব দেখা যায়নি। বরং পুরো মেলাটি এখন নাগরদোলা, নৌকা দোলা, মোটরসাইকেল সার্কাস ও বিনোদনমূলক গেমসের মেলায় রূপ নিয়েছে।
 

ইন্ডিয়ান বল ধামাকা’ গেমসের নামে জুয়া :


মেলার মাঝামাঝি স্থানে দেখা গেছে “ইন্ডিয়ান বল ধামাকা” নামের একটি গেমস স্টল, যেখানে ৬টি বল নিক্ষেপে ধরা হয় একটি গেম। এই ১ গেমের দাম ৪০ টাকা। বল মেলাতে পারলে আকর্ষণীয় পুরস্কার ‘স্মার্ট টিভি বা মোবাইল ফোন’ দেওয়া হচ্ছে। এতে লোভে পড়ে অনেক দর্শনার্থী, বিশেষ করে তরুণরা, গেমসের নামে এই জুয়া খেলায় জড়িয়ে পড়ছেন। তার পাশে আরও রয়েছে বক্সিং গেম ও বিভিন্ন ভাগ্যনির্ভর খেলার নামে জুয়া খেলা।
 

স্মোকিং বিস্কিট’ এর নামে মাদক :


গেম স্টলগুলোর পাশেই ‘স্মোকি বিস্কিট’ নামে একটি স্টলে ছোট শিশু থেকে নারী-পুরুষ সবাইকে ভিড় করতে দেখা গেছে। প্রথম দেখায় সাধারণ বিস্কুটের মতো মনে হলেও, এটি আসলে নেশাজাতীয় মাদকমিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য। বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ এই “স্মোকিং বিস্কিট”-এ গাঁজা, আইস বা কৃত্রিম মাদক মিশিয়ে তৈরি করা হয়। খাওয়ার পর মাথা ঘোরা, অস্বাভাবিক আনন্দ বা ‘হাই’ অনুভূতি তৈরি হয়, যা মাদকের প্রভাব।


চিকিৎসকদের মতে, এ ধরনের মাদকমিশ্রিত খাদ্য মানবমস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করে, মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং আসক্তির ঝুঁকি তৈরি করে। বাংলাদেশে এমন খাদ্য উৎপাদন, বিক্রি বা সেবন দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ মেলায় প্রকাশ্যে খোলামেলাভাবে চড়া দামে এই নিষিদ্ধ ‘স্মোকি বিস্কিট’ বিক্রি করা হচ্ছে।
 

অবৈধ টিকিট বিক্রি ও শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ:
 

মেলায় প্রবেশের জন্য প্রতিজনকে ২০ টাকার টিকিট কিনতে হচ্ছে। অথচ জেলা প্রশাসনের অনুমতিপত্রে প্রবেশমূল্য গ্রহণের কথা বলা হয়নি। এছাড়াও মেলার ভেতরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই। বরং শুধুমাত্র রঙিণ বাতির ঝলকানিতে সীমাবদ্ধ।
মেলায় উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছে, যা অনুমতির শর্তের পরিপন্থী। স্বেচ্ছাসেবক বা নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতিও দেখা যায়নি।


স্থানীয়রা জানান, জেলা প্রশাসকের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল “গেন্ডা খেলার মাঠে” মেলা আয়োজনের জন্য। কিন্তু বাস্তবে মেলা বসানো হয়েছে “ইমু সাহেবের বালুর মাঠে” যা প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করার সামিল। স্থানীয়দের মতে, “গেন্ডা খেলার মাঠ” নামে কোনো মাঠই নেই; এটি এক ধরণের প্রতারণার মাধ্যমে নেওয়া অনুমতির অপব্যবহার।
 

শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও উদ্বেগ:
 

মেলায় দেখা গেছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ভিড়। বর্তমানে সাভার পৌর এলাকায় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। এমন সময়ে মেলার আয়োজন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট করছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এই সময় ও স্থানে মেলার অনুমতি দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
 

জেলা প্রশাসনের অনুমতি ও শর্তাবলি:


২১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ঢাকা জেলা প্রশাসকের বিচার শাখা থেকে স্মারক নম্বর ০৫.৪১.২৬০০.০০০.০১১.১৮.০০০৫.২৫.২৫৮৫ এর মাধ্যমে “অর্গানিক খাদ্য পণ্য, কৃষি পণ্য প্রদর্শনী ও শিল্প বাণিজ্য মেলা-২০২৫” আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়। আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ অর্গানিক ফারমার্স অ্যান্ড রিটেইলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বোফরা)-এর সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আল তুষার।
পুলিশ সুপার (ডিএসবি), ঢাকা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সাভারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত মেলার সময় নির্ধারণ করা হয়।


অনুমতিপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মেলা পরিচালনায় গেন্ডা খেলার মাঠ কমিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই অশ্লীল নৃত্য, গান, জুয়া বা অবৈধ কার্যকলাপ করা যাবে না। উচ্চ শব্দে যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকবে।
কিন্তু মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এসব শর্তের অধিকাংশই লঙ্ঘিত হয়েছে।
 

সচেতন মহলের দাবি:


স্থানীয় সচেতন মহল, অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদরা বলছেন, “অর্গানিক খাদ্য ও কৃষি পণ্য প্রদর্শনীর নামে বাণিজ্যিক জুয়া, মাদক ও নিম্নমানের পণ্যের মেলা চলছে। এটি শুধু প্রতারণা নয়, জনস্বার্থ ও তরুণ সমাজের জন্য হুমকি।” এছাড়াও বছর শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। মেলার কারণে আশপাশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। তারা অবিলম্বে আবাসিক এলাকায় মেলার নামে জুয়া খেলা বন্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
 

সর্বাধিক পঠিত