স্টাফ রিপোর্টার : চলতি মাসের মাঝামাঝি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ জারি করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। সেভাবেই প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি খসড়া আদেশ চূড়ান্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় না এলে, আদেশে কী কী থাকবে, সরকারই সিদ্ধান্ত দেবে।
আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে খসড়া উত্থাপন করা হতে পারে। গণভোট কখন হবে– এ সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
যমুনা সূত্র জানায়, উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
গত সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার আহ্বান জানানো হয়। নিজেদের উদ্যোগে আলোচনা করে সাত দিনের মধ্যে সরকারকে দিকনির্দেশনা দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল, যা আজ রোববার শেষ হচ্ছে।
দলগুলোর সমঝোতা না হলে এরপর কী– প্রশ্নে ফাওজুল কবির বলেছেন, সময় সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেওয়া হয়নি। তার পরও সমঝোতা না হলে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। চলতি মাসের মাঝামাঝি জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করা হতে পারে। এ জন্য সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, আগামী ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠক হবে। বিশেষ কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে এর আগে জরুরি বা অনির্ধারিত বৈঠকের সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত নেই।
গত ৩০ অক্টোবরের বৈঠকে অধিকাংশ উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনে মতামত দেন। তবে গত সোমবারের বৈঠকে একাধিক উপদেষ্টা প্রশ্ন তোলেন, গণভোট ও নির্বাচন এক দিনে হলে, পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনসহ যেসব সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন জরুরি, সেগুলোর কী হবে? ফাওজুল কবির বলেছেন, গণভোট কখন হবে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান উপদেষ্টা।
রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষণ ক্ষীণ
আদেশ জারির মাধ্যমে গণভোটে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গত ২৮ অক্টোবর সরকারকে সুপারিশ করে ঐকমত্য কমিশন। সদ্য বিলুপ্ত এ কমিশনের সুপারিশে বলা নেই, আদেশ কে জারি করবে এবং গণভোট কখন? এ দুই সিদ্ধান্ত তারা সরকারকে নিতে বলেছে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, গণভোট হবে আদেশের ওপর। গণভোটে তা অনুমোদিত হলে, আগামী নির্বাচনে দ্বৈত ভূমিকার সংসদ গঠন হবে। সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত কন্সটিটুয়েন্ট ক্ষমতার ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ সনদ বাস্তবায়ন করবে।
কমিশনের তৈরি আদেশের প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে না পারলে, অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি সংবিধান সংশোধনের বিল পাস বলে গণ্য হবে। গণভোট হবে আদেশ এবং সংবিধান সংশোধনের বিলের ওপর।
দ্বিতীয় খসড়ায় বলা হয়েছে, গণভোট হবে আদেশ এবং তপশিলে যুক্ত সংস্কারের ৪৮টি প্রস্তাবের ওপর। ২৭০ দিনে গণভোটে অনুমোদিত তপশিল অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে পরিষদ।
কমিশনের সুপারিশে সনদে সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) থাকলেও, তপশিলে তা নেই। অর্থাৎ, গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট থাকবে না।
বিএনপি আদেশ নয়, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণভোট চায়। দলটি বলছে, গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট থাকতে হবে। যে দল যে সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, জয়ী হতে পারলে সেই অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করবে। গণভোট হতে হবে নির্বাচনের সঙ্গে।
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই অবস্থানের বিপরীতে। দুটি দলই নোট অব ডিসেন্টমুক্ত গণভোট চায়। জামায়াতসহ আট দল নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে।
দলগুলোর এ পরস্পরবিরোধী অবস্থান দূরে সরকার সমঝোতার আহ্বান জানালেও, আলোচনা হয়নি গত ছয় দিনে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, কোনো দলের আহ্বানে নয়, প্রধান উপদেষ্টা ডাকলে তারা আলোচনায় যাবেন।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, বিএনপিকে আলোচনার জন্য টেলিফোন করা হয়েছিল, তারা সাড়া দেয়নি।
বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব কমাতে এনসিপিসহ ৯ দলের উদ্যোগ এবং উপদেষ্টাদের দূতিয়ালিও ব্যর্থ হয়েছে। যমুনা সূত্র জানিয়েছে, সরকার আলোচনার জন্য কাউকে ডাকবে না। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে না চাইলে দলগুলোকে সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে হবে। নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপি সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে বলেও মনে করছেন উপদেষ্টারা।
গণভোট এবং আদেশ নিয়ে বিতর্ক
২০১১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে। গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর মামলায় গণভোট-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের রায় দেন।
বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে গণভোটে রাজি হলেও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, সংবিধানে গণভোট নেই। আগামীতে নির্বাচনে পাস করে সংসদে গিয়ে সংবিধানে যুক্ত করার পর গণভোট হতে পারে।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের কে বলেছেন, বিধান না থাকলে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া কীভাবে গণভোট করেছিলেন? গণভোট হতে হবে নির্বাচনের আগে, নভেম্বরে।
গতকাল জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আট দল গণভোটের দাবিতে আগামী মঙ্গলবার ঢাকায় জনসভা করে সেখান থেকে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
জামায়াত ও এনসিপির দাবি, আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি নন, আদেশ জারি করতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে। একাধিক উপদেষ্টা বলেছেন, আদেশ জারি হবে আইনানুগভাবে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ১০ বার আদেশ ও সংশোধিত আদেশ জারি করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তিনি ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও ছিলেন। ৩০ নভেম্বর সরকারের প্রধান নির্বাহী তথা সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান। এরপরও আদেশ জারি করা হয় রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সূত্রগুলো বলছে, গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে আদেশ জারি করা হলেও, তা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে করতে হবে।
গত ১৭ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সই করা জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতিসহ ১৫ প্রস্তাবে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।
জামায়াত ও এনসিপির সন্দেহ, বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের মতো করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। তাই গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট মানা হবে না। উচ্চকক্ষে পিআরও হতে হবে।
