স্টাফ রিপোর্টার : প্রতিবছরের মতো এবারও ১৫ জুলাই বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’ পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ২০১৪ সালে এই দিবস ঘোষণা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল যুবকদের দক্ষতা উন্নয়নের গুরুত্ব প্রচার, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে উৎসাহিত করা, যুব বেকারত্ব কমাতে দক্ষতাভিত্তিক উদ্যোগে জোর দেওয়া এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে যুবকদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য– ‘ইয়ুথ এমপাওয়ারমেন্ট থ্রু এআই অ্যান্ড ডিজিটাল স্কিলস’। অর্থাৎ এআই ও ডিজিটাল দক্ষতার মাধ্যমে যুবসমাজের ক্ষমতায়ন।
শ্রমবাজারের ওপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১০টি পেশাকে বিশ্বব্যাপী দ্রুত বিলুপ্তপ্রায় পেশা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো– ডেটা এন্ট্রি অফিসার, ডাকপিয়ন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত সহকারী, হিসাবরক্ষক, ব্যাংক কাউন্টার কর্মকর্তা, প্রিন্টিং ওয়ার্কার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, হাউসকিপার ও বিল্ডিং কেয়ারটেকার। বিভিন্ন দেশে এসব পেশায় কর্মরতরা ইতোমধ্যে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ কারণে বাংলাদেশে ঝুঁকিতে থাকা এসব পেশায় কর্মরতদের রিস্কিলিং (বিদ্যমান পেশা থেকে নবসৃষ্ট পেশায় স্থানান্তর) ও আপস্কিলিং (শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যমান পেশার উন্নয়ন) করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি শিল্প, শ্রম ও দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালাকে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন, যা কর্মজীবী জনগোষ্ঠী ও অর্থনীতিকে এআই-নির্ভর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করবে।
শ্রমবাজারের ওপর এআইর প্রভাব বহুমাত্রিক। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এটি যেমন পুনরাবৃত্তিমূলক ও রুটিন কাজগুলো বিলুপ্ত করছে, তেমনি তৈরি করছে নতুন নতুন কর্মের ক্ষেত্র; যেগুলোর জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিগত, বিশ্লেষণাত্মক ও ডিজিটাল দক্ষতা। একটি দেশ কতটা সফলভাবে এই ডিজিটাল রূপান্তরকে তার তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজে লাগাতে পারছে, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে সে দেশের সফলতা। ইউনেস্কোর এক জরিপ বলছে, বিশ্বব্যাপী মাত্র ১০ শতাংশের কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এআই সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। অথচ ২০৩৩ সালের মধ্যে এআইর বাজারমূল্য ৪.৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যদিও তার ব্যবহার সীমিত সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর হাতেই থাকবে বলে প্রতীয়মান।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, আগামী দিনে যুবসমাজের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পেশাগুলো হলো– এআই ও মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, রোবোটিকস প্রকৌশলী, ডেটা বিজ্ঞানী, ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ। বিশ্বব্যাপী চলমান এ ডিজিটাল রূপান্তরের কারণে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ, ক্লাউড কম্পিউটিং বিশেষজ্ঞ এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ম্যানেজার পদের চাহিদা দ্রুত বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি সবুজ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু পেশাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিবিদ, সার্কুলার ইকোনমি বিশেষজ্ঞ ও টেকসই উন্নয়ন পরামর্শক, যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই এআই সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
শ্রমবাজারের ওপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১০টি পেশা বিশ্বব্যাপী দ্রুত বর্ধনশীল হিসেবে চিহ্নিত। পেশাগুলো হলো: বিগ ডেটা বিশেষজ্ঞ, ফিনটেক প্রকৌশলী, এআই ও মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপার, ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ, সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ, স্বচালিত ও বৈদ্যুতিক যানবাহন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকৌশলী, তথ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনার।
বাংলাদেশের তরুণরা ইতোমধ্যে ডিজিটাল দক্ষতায় নিজেদের ভালো অবস্থানে উন্নীত করেছে, যদিও তা দেশি-বিদেশি শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট নয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যুবসমাজের জন্য আরও নতুন নতুন পেশায় দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও এ খাতের বিভিন্ন পেশায় (গ্রাফিকস ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং) কর্মরতদের ৮০ শতাংশ পুরুষ ও শহরকেন্দ্রিক। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর ও নারী-পুরুষের মধ্যকার বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করে সমাজের সব অংশের তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে হলে প্রয়োজন এআই ও ডিজিটাল দক্ষতাবিষয়ক নতুন নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন, নবসৃষ্ট পেশায় তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন, শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, শিক্ষার প্রতিটি স্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ার গাইডেন্স নিশ্চিতকরণ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা-দক্ষতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারি- বেসরকারি খাতের, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও, সিভিল সোসাইটিসহ সবাইকে অর্থাৎ ‘হোল অব সোসাইটি অ্যাপ্রোচ’ নিয়ে কাজ করতে হবে।
এইচ.এম. আসাদ-উজ-জামান: শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
azaman.asad@gmail.com
মো. রমজান আলী: শিক্ষায় প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
rubel.ier.du@gmail.com