বৃহস্পতিবার, 6 নভেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

এক পরিবারে একজন করেই পেলেন বিএনপির মনোনয়ন | dailyfulki

 

স্টাফ রিপোর্টার : আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ঘোষিত ২৩৭ আসনের মনোনয়ন তালিকায় এবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দলটির ‘এক পরিবার, এক প্রার্থী’ নীতির বাস্তবায়ন। ঘোষিত তালিকায় দেখা গেছে, বিএনপির শীর্ষ ও প্রভাবশালী পরিবারগুলোর মধ্য থেকে একজনের বেশি কাউকে প্রার্থী করা হয়নি। ফলে দলের এই পদক্ষেপ শুধু আগের ঘোষণাকে বাস্তব রূপই দেয়নি, বরং বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির সংস্কৃতিতে এক ভিন্ন বার্তাও দিয়েছে।

সোমবার (৩ নভেম্বর) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন।


ঘোষিত তালিকায় দেখা গেছে—বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান বা কেন্দ্রীয় নেতাদের পরিবারের মধ্যে যেসব আসনে একাধিক সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন, সেখানে শেষ পর্যন্ত একজনকেই দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি নির্দেশে এই নীতি কার্যকর করা হয়েছে। তিনি আগেই স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এক পরিবার থেকে একাধিক সদস্যকে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। সেই নির্দেশনা এবার কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ফলে মির্জা আব্বাস–আফরোজা আব্বাস, গয়েশ্বর রায়–নিপুণ রায় চৌধুরী, খায়রুল কবির খোকন–শিরীন সুলতানা, সালাহউদ্দিন আহমদ–হাসিনা আহমদ, আব্দুস সালাম পিন্টু–সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মীর নাসির–মীর হেলালসহ একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার থেকে এবার একজন করেই মনোনয়ন পেয়েছেন।

ঢাকার রাজনীতিতে আলোচিত মির্জা আব্বাস–আফরোজা আব্বাস পরিবারে মনোনয়ন পেয়েছেন মির্জা আব্বাস নিজেই। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও তার পুত্রবধূ নিপুণ রায়ের ক্ষেত্রে প্রার্থী হয়েছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। নিতাই রায় চৌধুরীর পরিবারে মনোনয়ন গেছে তার হাতেই, মেয়ে নিপুণকে দেওয়া হয়নি।

একইভাবে ঢাকা-৪ আসনে প্রার্থী হয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমদের ছেলে তানভীর আহমেদ রবিন; টাঙ্গাইলে পিন্টু-টুকু ভাইদের মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন আব্দুস সালাম পিন্টু। চট্টগ্রামে মীর নাসিরের পরিবর্তে মনোনয়ন গেছে তার ছেলে মীর হেলাল উদ্দিনের হাতে। এ ছাড়া ড. আব্দুল মঈন খান, আমান উল্লাহ আমান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, খায়রুল কবির খোকন ও আব্দুল আউয়াল মিন্টু নিজ নিজ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন।


তবে ব্যতিক্রম দেখা গেছে কেবল জিয়া পরিবারে। ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিবার থেকে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মনোনয়ন পেয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়াকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ফেনী–১, বগুড়া–৭ ও দিনাজপুর–৩ আসনে এবং তারেক রহমানকে বগুড়া–৬ আসনে।

তবে দলীয় ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। যদিও তার নাম প্রার্থী তালিকায় রাখা হয়েছে, তবে বাস্তবে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ নির্ভর করবে শারীরিক সুস্থতার ওপর। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিনের পারিবারিক প্রভাবমুক্ত রাজনীতি প্রতিষ্ঠার একটি দৃশ্যমান পদক্ষেপ। পরিবারতন্ত্র ভাঙার এই প্রয়াসকে তারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, “বিএনপি যদি এই নীতিটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই পরিবারতন্ত্র রাজনীতির নেতৃত্বের ধারাকে স্থবির করে রেখেছে, বিএনপির এই পদক্ষেপ সেই স্থবিরতার ভেতর নতুন আলো জ্বালিয়েছে।”

তবে বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, ‘এক পরিবার এক প্রার্থী’ নীতির বাস্তবায়ন যতটা প্রতীকী, ততটাই চ্যালেঞ্জিংও। কারণ, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও মূলত জিয়া পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে এই নীতি কতটা গভীরে গিয়ে কার্যকর হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ বলছেন, এতে দলের ভেতরের প্রভাবশালী পরিবারের আধিপত্য কমবে; কেউ আবার মনে করছেন, এতে অনেক ত্যাগী ও আন্দোলনকেন্দ্রিক নেতাদের পরিবারের সদস্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। তবুও সার্বিকভাবে বেশিরভাগ নেতাই বলছেন, নীতিগত এই সিদ্ধান্ত দলের পুনর্গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

দলীয় সূত্র জানায়, ‘এক পরিবার এক প্রার্থী’ নীতি শুধু মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক সংস্কারের অংশ। তারেক রহমানের লক্ষ্য, বিএনপির প্রার্থিতা নির্ভর করবে যোগ্যতা, ত্যাগ ও জনপ্রিয়তার ওপর, আত্মীয়তার ওপর নয়। এর মাধ্যমে তিনি “পরিবারতন্ত্র বনাম ত্যাগী কর্মী” দ্বন্দ্বে ভারসাম্য আনতে চাইছেন।

বিএনপির ভেতরেই কেউ কেউ মনে করছেন, এই নীতির প্রয়োগ প্রশংসনীয় হলেও নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নতুন কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ, একই পরিবারের যোগ্য ও ত্যাগী সদস্যদের মধ্যে কাউকে বাদ দেওয়া সবসময় সহজ নয়। তবু বিএনপি যদি দলীয় গণতন্ত্র ও যোগ্যতার নীতিতে অটল থাকতে পারে, তবে এটি শুধু নির্বাচনী কৌশল নয়, বরং দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
 

সর্বাধিক পঠিত