সোমবার, 3 নভেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

বিএনপির ‘দুর্গে’ তারেক রহমানের জন্য কোন আসন |dailyfulki

 

স্টাফ রিপোর্টার : প্রায় দুই দশক ধরে দল ও নির্বাচন পরিচালনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও তিনি কখনো সরাসরি ভোটের মাঠে প্রার্থী হননি; তবে এবার নিজেই নির্বাচনে দাঁড়ানোর ইচ্ছার কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

অক্টোবরের শুরুতে বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে যখন তারেক রহমানকে প্রশ্ন করা হল, তিনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন কি না, তিনি বলেছিলেন, “জি, ইনশাআল্লাহ।”

তারেক কোন আসনে প্রার্থী হবেন–এ বিষয়ে বিএনপি এখনো ঘোষণা দেয়নি। তবে জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় ধারণা করা যায়, বাবার বাড়ির এলাকা বগুড়া থেকেই তার ভোটে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।


প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়া ‘বিএনপির ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সেই ১৯৯১ সাল থেকে বগুড়ার দুটি আসনে নির্বাচন করে আসছেন। বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাহজাহানপুর) আসনে তিনি কখনো পরাজয়ের মুখ দেখেননি।


এর কোনটিতে তারেক রহমান প্রার্থী হবেন–তা এখনো নিশ্চিত না। যদিও বগুড়া-৭ আসনে তাকে প্রার্থী হিসেবে পেতে চান দলের তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী।

বগুড়া-৭ সংসদীয় আসনের বিগত ১২টি নির্বাচনের মধ্যে বিএনপি ছয়বার (এর মধ্যে খালেদা জিয়া পাঁচবার), জাতীয় পার্টি তিনবার, আওয়ামী লীগ দুবার এবং স্বতস্ত্র (বিএনপির সমর্থনে) প্রার্থী একবার জয় পেয়েছেন।


বগুড়ায় বিএনপির তৃণমূল নেতাদের অনেকের কাছে তারেক রহমান ‘ভাইয়া’ হিসেবে পরিচিত। তাদের প্রত্যাশা, তিনি এখান থেকেই নির্বাচন করুন।

খালেদা জিয়া চারবর বগুড়া-৬ আসন নিজের হাতে রেখে বগুড়া-৭ আসনটি ছেড়ে দিয়েছেন।

বগুড়া-৭ আসনে চারবারের মধ্যে একবার (২০০৮ সালের) উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন মওদুদ আহমদ। বাকি তিনবার (১৯৯১, ১৯৯৬-জুন এবং ২০০১ সালের) জয়ী হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু।

সাবেক সংসদ সদস্য লালু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বগুড়া-৭ আসন থেকেই নির্বাচন করবেন। আমরা তার পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার করে যাচ্ছি। আমি ম্যাডামকেও (খালেদা জিয়া) এই বিষয়ে অনুরোধ করেছি।”

‘সবুজ সংকেত’

জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ১১ অক্টোবর ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বগুড়ার সাতটি আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সভা ছিল। সেই সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন তারেক রহমান। সভায় মোট ২২ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন।

তারেক রহমান মনোনয়ন প্রাত্যাশীদের কথা শুনেছেন এবং আগামী নির্বাচনে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক, ‘তার সঙ্গে কাজ করার’ নির্দেশ দিয়েছেন। সবাই এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।

সেই সভায় উপস্থিত একজন নেতা বলেন, সভার তিন দিন পর পাঁচজনকে ফোন করে নির্বাচনি প্রচার জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


এর মধ্যে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দী-সোনাতলা) আসনে রফিকুল ইসলাম, বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) মীর শাহে আলম, বগুড়া-৩ (আদমদিঘী-দুপচাচিয়া) মজিদ তালুকদার, বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দিগ্রাম) মোশাররফ হোসেন এবং বগুড়া-৫ জি এম সিরাজকে ফোন করা হয়েছে বলে স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য।

তবে বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাহজাহানপুর) আসনের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা হয়নি। ফলে নেতাকর্মীরা ধরে নিয়েছেন, হয়ত বগুড়া-৬ আসনে খালেদা জিয়া এবং বগুড়া-৭ আসনে তারেক রহমান লড়বেন।

খালেদা জিয়া বগুড়া জেলা কমিটির ১ নম্বর এবং তারেক রহমান ২ নম্বর সদস্য হিসেবে রয়েছেন।

বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি মো. রেজাউল করিম বাদশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনবদ্য পরিবেশে ঢাকায় ভার্চুয়াল সভা করেছেন তারেক রহমান। সবাই বলেছি, যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক, তার পক্ষে একযোগে মিলেমিশে কাজ করব আমরা। উনার আহ্বান এবং আমাদের প্রতিশ্রুতি তৃণমূল নেতারা সাদরে গ্রহণ করেছেন।

“ওই সভার তিন দিন পর পাঁচ নেতাকে ফোন দিয়ে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে এবং মনোনয়ন প্রত্যাশী সবাইকে নিয়ে মাঠে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করতে বলেছেন।”

রেজাউল করিম বলেন, “বগুড়া-৬ (সদর) এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি বগুড়া-৭ (গাবতলী) আসন বিষয়ে কোনো কিছু কাউকে বলা হয়নি। দুটি আসন থাকবে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের জন্য।”

‘সবুজ সংকেতের’ ফোন পাওয়ার কথা বলেছেন জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. মোশাররফ হোসেন।

তিনি বলেন, “আমাকেসহ পাঁচজনকে তারেক রহমান ফোন করে মনোনয়নের সবুজ সংকেত দিয়েছেন। তবে তিনি নিজে কোথা থেকে ভোট করবেন খোঁজ রাখিনি। সারা বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে করতে পারেন।

“তবে, আমরা চাই, বগুড়া সদর কিংবা গাবতলী থেকেই ভোট করুন। কারণ, উনি বগুড়ার সন্তান এবং বগুড়ার সমস্যাগুলোর বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি, তাই তার জন্য বগুড়ার আসন কাম্য।”


তৃণমূলের ভাবনা

কারাদণ্ডের কারণে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাথী হতে পারেননি। তখন অনেক নেতার ভাগ্যেই এমনটা ঘটেছে। কৌশলগত কারণে তখন এক আসনে একাধিক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে বিএনপি।

সেবার বগুড়া-৭ আসন থেকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে গাবতলী উপজেলার বিএনপির সভাপতি মোর্শেদ মিল্টনের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। ফলে এই আসনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না। বিএনপি তখন স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম বাবলুকে সমর্থন দেয়। তিনি জয়লাভ করেন।

মোর্শেদ মিল্টনের ভাষ্য, “আমরা মাঠে-ময়দানে তারেক রহমানের জন্য কাজ করছি। তারেক রহমানের পক্ষে ধানের শীষে ভোট চেয়ে যাচ্ছি। তারেক রহমান আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী হবেন এটা আমাদের বগুড়া তথা গাবতলীর গৌরব। আশা করছি, তিনি গাবতলী থেকেই নির্বাচন করবেন।”

প্রায় একই কথা বলেন গাবতলী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক নুতন।

তিনি বলেন, “আমরা ভাইয়ার পক্ষে ধানের শীষে ভোট চাইতে দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছি। মানুষের আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে অন্য প্রার্থীর জামানত থাকবে না।”

গাবতলী উপজেলার মহিষাবান এলাকার ভ্যানচালক জসিম উদ্দিন বলছিলেন, ‘এখানে সবসময় জিয়া পরিবারের প্রাধান্য রয়েছে। যদি ভালোভাবে নির্বাচন হয় তাহলে হয়ত এখানে সেই পরিবারের কেউ প্রার্থী হবেন।”

জসিমের ভাষ্য, তিনি শুনেছেন, এখানে তারেক রহমান প্রার্থী হবেন। তার ধারণা, সুষ্ঠু ভোট হলে এখানে বিএনপির জয় বড় ব্যবধানে হবে।

প্রায় একই কথা বলছিলেন সোনারায় গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ এবং বাগবাড়ীর বাবলু তালুকদার।


আরও যারা প্রার্থী

এই তিনবার জাতীয় পার্টি বিজয়ী হলেও ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকে দলটির নেতাকর্মীদের অনেকেই মাঠ ছেড়ে গেছেন। গত প্রায় ১৫ মাসে দলের কর্মসূচি দেখা যায়নি। দলটির জেলা কমিটির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্না এবং সাবেক সংসদ সদস্য জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ওমর অনেকটাই আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের নামে মামলা রয়েছে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৭ আসনে দলীয় প্রার্থীর বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম ওমর বলেন, “দেখুন, এ ব্যাপারে আমরা এখনো কিছু জানি না। দল থেকে এ বিষয়ে এখনও কিছু জানানো হয়নি।”

আর শরিফুল ইসলাম জিন্নাকে ফোন দিলে তিনি ধরেননি।

তবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এরই মধ্যে এই আসনে প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সহসভাপতি গোলাম রব্বানীর নাম ঘোষণা করেছে। তিনি দুই উপজেলায় সমানতালে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।

অপরদিকে বগুড়া-৬ (সদর) আসন থেকে জামাতে ইসলামীর শহর শাখার সভাপতি আবিদুর রহমান সোহেলের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।

আবিদুর রহমান সোহেল বলেন, “বগুড়াকে বিএনপির ঘাঁটি বললেও তা আর আগের মত নেই। পরিবর্তন হয়েছে অনেক। আমাদের সদস্য সংখ্যাও বেড়েছে, প্রচার বেড়েছে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এখনও এই আসনে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি।

এনসিপি বগুড়ার প্রধান সমন্বয়কারী সাকিব মাহাদী বলেন, “বগুড়ায় এখনও কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তবে গাবতলীতে কাকে মনোনয়ন দেওয়া যায়, এজন্য রাফিয়া সুলতানা নামের এক নেত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর বগুড়া সদর আমি দেখছি। সাতটি আাসনেই মনোনয়ন দেওয়া হবে আগামী মাসেই।”


আগের ইতিহাস

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, বগুড়া-৭ আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১২ হাজার ২৫৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৭৩ এবং নারী ২ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮৩।

এই আসন থেকে ১৯৭৩ সালে (প্রথম সংসদ নির্বাচন) আওয়ামী লীগের মোস্তাফিজুর রহমান পটল নির্বাচিত হন।

১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এখান থেকে বিএনপির সিরাজুল হক তালুকদার বিজয়ী হন।

১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তৃতীয় ও চতুর্থবার এই আসনে জয়ী হন জাতীয় পার্টির আমিনুল ইসলাম সরকার পিন্টু।

১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিজয়ী হন। এরপর ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি) সালের ষষ্ঠ, ১৯৯৬ (জুন) তারিখের সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি জয়লাভ করেন।

২০০৮ সালে খালেদা জিয়া এই আসন ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বিজয়ী হন। আর (১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি বাদে) বাকি তিনবারই উপ-নির্বাচনে জয় পান হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু।

২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে এখানে সংসদ সদস্য হন জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট আলতাফ হোসেন।

২০১৮ সালে (একাদশ সংসদ নির্বাচনে) বিএনপির সমর্থন নিয়ে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম বাবলু। সবশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ডা. মোস্তফা আলম নান্নু সংসদ সদস্য হন।

 

সর্বাধিক পঠিত