বৃহস্পতিবার, 23 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় পরিচালনায় পরামর্শ কমিশন গঠনে আপত্তি

 

স্টাফ রিপোর্টার : সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতে একটি কমিশন গঠন করা হবে। প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে কমিশনে সদস্য হিসেবে থাকবেন আইনমন্ত্রী বা উপদেষ্টা, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও অ্যাটর্নি জেনারেল।

এমন প্রস্তাব রেখে আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উঠছে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এদিকে পরামর্শ কমিশন গঠনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন বিচার প্রশাসনের বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যে, সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলা অনুযায়ী এমন কমিশন গঠনের কোনো সুযোগ নেই। বড় বিষয় হলো, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ে প্রশাসনের লোক ঢুকলে তা স্বাধীন থাকবে কীভাবে?

জানা যায়, অধ্যাদেশে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় বিচার বিভাগের আর্থিক, বাজেট ব্যবস্থাপনা, পদায়ন-পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণসহ সব বিষয়ে কাজ করবে। তাদের এসব কাজ করার ক্ষেত্রে পরামর্শ দেবে কমিশন।

কমিশন গঠনে মত দিলেও আগের খসড়া অধ্যাদেশে বিচারকদের নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত কমিটিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে রাখার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছিল বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। পরে তা সংশোধন করে চূড়ান্ত খসড়া করা হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ কার্যকর হলে বিচার বিভাগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হবে। অধ্যাদেশ অনুমোদন হলে একটি কমিশনও গঠন করা হবে। ওই কমিশনের কর্মপরিধি পরবর্তী সময়ে বিধিমালার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। সম্ভবত কমিশন আইনি ও বিধিবিধানের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়কে পরামর্শ দেবে বলে জানান তিনি।

তবে কমিশন গঠনের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ এবং বিসিএস বিচার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মাসদার হোসেন সমকালকে বলেন, বিচার বিভাগের যে কোনো কাজ সম্পাদনে প্রস্তাব দেবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়। তাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য পৃথক কমিশন গঠন সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলা অনুযায়ী করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ে প্রশাসনের লোক ঢোকানো হলে, তা গুড়ে বালি হবে। কারণ মাসদার হোসেন মামলার আট দফার নির্দেশনা, অর্থাৎ বিচার বিভাগকে প্রশাসন ও আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখতে হবে। এ নির্দেশ লঙ্ঘন করে কমিশনের নামে সচিবালয়ে সরকারের কোনো প্রতিনিধি বা অন্য কাউকে রাখা হলে তা সংবিধানের ২২ ধারার লঙ্ঘন। একই সঙ্গে মাসদার হোসেন মামলার আট দফাও লঙ্ঘিত হবে, যা সংবিধান ও আইনবহির্ভূত।

কী আছে অধ্যাদেশে
খসড়ায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির হাতে থাকবে এবং সচিব হবেন প্রশাসনিক প্রধান। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিব সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিবের সমমর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করবেন। সচিব পদে নিয়োগ পাবেন জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে একজন সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত হবে।
এতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে অধস্তন আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে পালনের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।

এ ছাড়া, এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তগুলো সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন বা বিধিতে যা কিছু থাক না কেন, এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি প্রাধান্য পাবে।

খসড়ায় বলা হয়, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণে একটি সচিবালয় থাকবে এবং তার নাম হবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়। এ সচিবালয়ের কার্যাবলি বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশের বিচার প্রশাসন পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তার নিমিত্তে অধস্তন আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব সাচিবিক দায়িত্ব পালন, সংসদ প্রণীত আইনসাপেক্ষে রাজস্ব আদালতসমূহ ব্যতীত হাইকোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের সব অধস্তন দেওয়ানি-ফৌজদারি আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা, এখতিয়ার, ক্ষমতা ও গঠন নির্ধারণ, হাইকোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সব আদালত বা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ করবে এ সচিবালয়।

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়, অধস্তন আদালত ও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের বাজেট ব্যবস্থাপনা, অধস্তন আদালত এবং বিচারকের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ, অধস্তন আদালতের বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করবে এ সচিবালয়।

১৮ বছর আগে পৃথক বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথক হয়েছিল এখন থেকে ১৮ বছর আগে, ২০০৭ সালে। নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে– এমন লক্ষ্য ছিল। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ ছিল বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পরও সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে এবং এটি স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা আইনজীবীসহ অংশীজনের দীর্ঘদিনের দাবি। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের উদ্যোগ নেয়।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্‌করণ সাংবিধানিকভাবে আরও সুদৃঢ় হবে।

এক বছর আগে পাঠানো হয় প্রস্তাব
পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব গত বছরের ২৭ অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নির্দেশনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন একটি ধারণাপত্রসহ এ প্রস্তাব পাঠায়। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রস্তাব ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রস্তুত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আজ এ অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে তুলছে।

জুলাই সনদেও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়
জুলাই সনদের ৫২ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথক্‌করণে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয় থাকবে এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে। বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এ সচিবালয়ে সংযুক্ত তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হবে। এ সচিবালয়ের ওপর অধস্তন আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রম, বাজেট প্রণয়ন, অধস্তন আদালতের বিচারকের পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হবে। সব রাজনৈতিক দল ও জোট এ বিষয়ে একমত হয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয় পরিচালনা নিয়ে বিরোধ
সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর আইন ও বিচার বিভাগে কাজ করবেন প্রশাসন ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা– এমন বিধান রেখে গত ২৮ জুলাই আইন ও বিচার বিভাগে পদায়ন বিধিমালা, ২০২৫ এর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আইন উপকমিটির সদস্য তাজউদ্দিন আইন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থায় নির্বাহী পদে কর্মরত বিচারকদের বিচার বিভাগে প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিবের কাছে আবেদন করেছেন।

আবেদনে বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থায় নির্বাহী পদে কর্মরত অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিচার বিভাগে প্রত্যাহার করে তার স্থলে নির্বাহী বিভাগের আইন ডিগ্রিধারী কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে। সরকার বনাম মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা ফৌজদারি আদালতসহ বিচার বিভাগীয় সব দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন। কিন্তু তখন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা সরকারের এবং নির্বাহী ও প্রশাসনিক পদসমূহ পরিত্যাগ করেননি।

 

সর্বাধিক পঠিত