মাসুম বাদশাহ, (সিংগাইর) মানিকগঞ্জ : দরিদ্র জেলে পরিবারের জন্ম, বাল্যবিবাহ, বিচ্ছেদ আর অভাব সব মিলিয়ে জীবনের শুরুটাই ছিল সংগ্রামের। সেই বৃষ্টি, যাকে বাবা আট বছর আগেই ত্যাজ্য করেছিলেন, আজ দেশের আলোচিত নাম নাদিয়া আক্তার বৃষ্টি। আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেফতার।
গত রোববার (১৯ অক্টোবর) গভীর রাতে বান্দরবান জেলা থেকে তাকে ও তার কথিত স্বামী মুহাম্মদ আজিমকে (২৮) গ্রেফতার করে সিআইডি। সোমবার সকালে তাদের ঢাকায় আনা হয়। এই গ্রেপ্তার ঘিরে দেশজুড়ে চলছে তুমুল আলোচনা সমালোচনা।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের দুর্গম চর পাটগ্রামের দরিদ্র জেলে পরিবারের সন্তান বৃষ্টি। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। শৈশবে ছিল হাসিখুশি, পরিশ্রমী ও সরল স্বভাবের। কিন্তু অভাবের সংসারে পড়ালেখা এগোয়নি। পরিবারের আর্থিক সংকটে মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সে তার বিয়ে দেওয়া হয় একই উপজেলার বয়ড়া ইউনিয়নের খালপাড় গ্রামের কাউসারের সঙ্গে। কৈশোরেই শুরু হয় সংসারজীবন, আর সেখান থেকেই জীবনের ভাঙন।
স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য, পরকীয়ার অভিযোগ আর পারিবারিক ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটে বৃষ্টির দাম্পত্যের। শ্বশুরবাড়ির লোকজন অভিযোগ করেন, দেনমোহরের টাকাসহ কয়েক লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি করে চলে যায় সে। এরপর হঠাৎ হারিয়ে যায় বৃষ্টি। পরিবার বা গ্রামের কারো সঙ্গেই আর যোগাযোগ রাখেনি। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ একদিন চরাঞ্চলে নানির বাড়িতে আসলে অনেকে তাকে চিনতেই পারেনি। গ্রামের সহজ-সরল মেয়েটির চেহারা, পোশাক-আচরণে এমন পরিবর্তন দেখে হতবাক হয় সবাই।
বৃষ্টির বাবা, এখন একজন ক্ষুদ্র চা দোকানি। তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ। মেয়েকে বলেছিলাম, কষ্ট হলেও সংসার কর। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, সে সমাজের বোঝা হয়ে গেছে। আমি তাকে মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিই না। বহু আগেই আমি তাকে ত্যাজ্য করেছি।
দরিদ্র পরিবারের সেই মেয়ে কবে, কোথায়, কিভাবে আন্তর্জাতিক পর্নো দুনিয়ায় জড়িয়ে পড়ল তা নিয়ে এখন গ্রামজুড়ে নানা আলোচনা। নাদিয়া আক্তার বৃষ্টি নিজেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান মডেল” হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি আন্তর্জাতিক পর্নো ইন্ডাস্ট্রির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
২০২৪ সালের ১৭ মে তারিখে তিনি প্রথম ভিডিও প্রকাশ করেন। ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি ১১২টি ভিডিও প্রকাশ করেছেন, যেগুলো বিশ্বব্যাপী দেখা হয়েছে ২৬৭ মিলিয়নেরও বেশি বার। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রাপ্তবয়স্ক বিনোদন প্ল্যাটফর্মে তিনি পারফর্মারদের মধ্যে অষ্টম স্থানে ছিলেন।
সিআইডির তথ্যানুযায়ী, বৃষ্টি ও আজিম যৌথভাবে একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল পরিচালনা করতেন, যেখানে দুই হাজারেরও বেশি সদস্য রয়েছে। সেখানে নিয়মিত তাদের ভিডিওর লিংক শেয়ার করা হতো। একাধিক সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টে তারা নিজেদের বিলাসী জীবনযাপন, অর্থ, দামি মোটরবাইক ও গাড়ির ছবি প্রকাশ করতেন। কিছু পোস্টে তারা নিজেদের ভিডিও থেকে লাখ টাকার আয় দেখিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডিসেন্ট’-এর প্রতিবেদনে তাদের আসল পরিচয় ও অবস্থান প্রকাশ পেলে সিআইডি তৎপর হয়। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে অবশেষে বান্দরবান থেকে তাদের গ্রেফতার করে।
এলাকাবাসী বলছেন, বৃষ্টি আগে ছিল শান্ত ও নম্র স্বভাবের। পরিবারের অভাব, অল্প বয়সে বিয়ে আর সামাজিক অবহেলাই হয়তো তাকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে। চর পাটগ্রামের মানুষের মুখে এখন একটাই প্রশ্ন, দারিদ্র্য ও সমাজের অবজ্ঞাই কি নাদিয়া আক্তার বৃষ্টিকে এই অন্ধকারে ডুবিয়েছে?
দরিদ্র জেলের ঘরে জন্ম নেয়া শান্ত স্বভাবের মেয়ে বৃষ্টি আজ আন্তর্জাতিক অন্ধকার দুনিয়ার পরিচিত মুখ। তার গ্রেপ্তারে স্বস্তি ফিরে এসেছে পরিবার ও এলাকাবাসীর মনে, কিন্তু একটি প্রশ্ন আজও থেকে গেছে, যদি সমাজ একটু পাশে দাঁড়াত, তবে হয়তো এমন অন্ধকারে হারিয়ে যেত না নাদিয়া আক্তার বৃষ্টি।