স্টাফ রিপোর্টার : দেশে বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, শিল্প-কারখানা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ‘উদ্দেশ্যমূলক’ অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে দেশে এমন অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ৯৯০টি। এসব ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে সাত শতাধিক। সম্পদহানি হয়েছে কোটি কোটি টাকার।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে মোট অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এক লাখ ২১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে তদন্তে দেখা যায়, ৯৯০টি আগুন লাগানো হয়েছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবে— অর্থাৎ প্রতিশোধ, শত্রুতা বা সংঘাতের কারণে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক দ্বন্দ্ব, জমি ও ব্যবসায়িক বিরোধ, পারিবারিক কলহ, এমনকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাও অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিসংযোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি হয়, এই কমিটি ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড রোধে নানান সুপারিশও করে। আইন অনুযায়ী মামলাও হয়। কিন্তু মামলার তদন্ত এগোয় না। কোনো কোনোটার তদন্ত শেষ হলেও বিচার পর্যন্ত যায় না সেই মামলা। এমন পরিস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ডে অবহেলার জন্য দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় সচেতন হয় না অন্যরাও। ফলে একের পর এক ঘটতে থাকে অগ্নিকাণ্ড।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগই দুর্ঘটনাজনিত হলেও শত্রুতামূলক আগুনের প্রবণতাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এগুলোর তদন্তে অনেক সময়ই দেখা যায়, পূর্বপরিকল্পিত বা ক্ষতি করা উদ্দেশ্য ছিল।
সবশেষ রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে লাগা ভয়াবহ আগুনের ঘটনা নাশকতা কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু কার্গো ভিলেজ নয়, দেশে সম্প্রতি চট্টগ্রামের ইপিজেডসহ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি উঠেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারও ইন্ধন থাকতে পারে বলে অভিযোগও রয়েছে।
বিমানবন্দরের ভেতরেই ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব ইউনিট রয়েছে। তারা সাধারণত বিমানের আগুন নেভাতে সক্ষম। এত শক্তিশালী ইউনিট থাকা সত্ত্বেও আগুন নিয়ন্ত্রণে এতটা সময় নেওয়া কর্তৃপক্ষের গাফিলতির দিকেই ইঙ্গিত দেয়।- ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ (পণ্য রাখার স্থান) কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ একশ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে অনুমান তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর।
এ আগুনের ঘটনায় সম্ভাব্য সব অভিযোগ আমলে নেওয়া হবে জানিয়েছেন বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আগুনের পূর্ব ও পরবর্তী অবস্থা, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণে একটি দেশ বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতির শিকার হয়। অসংখ্য মানুষের প্রাণ চলে যায়। জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা কোনো রকমে বেঁচে যান, তারা আজীবন মানসিক সংকট নিয়ে দিনাতিপাত করেন। শারীরিক অপূর্ণাঙ্গতা তো আছেই। একেকটি অগ্নিকাণ্ডের কারণে একটি দেশ বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়।
দেশে গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় দুর্বৃত্তদের দেওয়া অগ্নিকাণ্ডে ঢাকার রামপুরায় বিটিভি ভবন, মিরপুর মেট্রোরেল স্টেশন, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, এক্সপ্রেসওয়ে, মহাখালীর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগসহ বিভিন্ন স্থাপনা আগুনে পুড়ে যায়। এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয় কয়েকশ কোটি টাকা।
৫ বছরে নিহত ৭২০
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বার্ষিক পরিসংখ্যান ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে দেশে মোট ৯৯০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে শত্রুতা বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে ২৫০টি, ২০২৩ সালে ২৩৬টি, ২০২২ সালে ১৫৭টি, ২০২১ সালে ১৬৭টি এবং ২০২০ সালে ১৮০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এ পর্যন্ত যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। অগ্নিসংযোগ কেবল সম্পদের ক্ষতি নয়, এটি মানব হত্যার শামিল একটি গুরুতর অপরাধ। এমন অপরাধ জনজীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।- অপরাধ বিশ্লেষক ওমর ফারুক
২০২৪ সালে ২৫০ আগুনে ক্ষতি হয় ৩ কোটি ২০ লাখ ৬৫ হাজার ৬২৪ টাকা, ২০২৩ সালে ২৩৬ আগুনে ক্ষতি ৯ কোটি ৮১ লাখ ৯ হাজার, ২০২২ সালে ১৫৭ আগুনে ক্ষতি ২ কোটি ৮২ লাখ ৬৪ হাজার ৭১৫, ২০২১ সালে ১৬৭ আগুনে ক্ষতি হয় ৩ কোটি ২৮ লাখ ১৮ হাজার এবং ২০২০ সালে ১৮০ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতি হয় ২১ কোটি ৭৪ লাখ ৫ হাজার ১১৩ টাকা।
পাঁচ বছরে অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা ৭২০ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে ১৪১ জন, ২০২৩ সালে ১০২, ২০২২ সালে ৯৮, ২০২১ সালে ২২৫ এবং ২০২০ সালে ১৫৪ জন নিহত হন।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান বলেন, ‘দফায় দফায় এমন বড় অগ্নিকাণ্ড কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি কেপিআইভুক্ত (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) এলাকা, যেখানে সার্বক্ষণিক মনিটরিং থাকার কথা। সেখানে আগুন লাগলেও এতক্ষণ ধরে জ্বলার কথা নয়।’
তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরের ভেতরেই ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব ইউনিট রয়েছে। তারা সাধারণত বিমানের আগুন নেভাতে সক্ষম। এত শক্তিশালী ইউনিট থাকা সত্ত্বেও আগুন নিয়ন্ত্রণে এতটা সময় নেওয়া কর্তৃপক্ষের গাফিলতির দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এসব আগুন দেশের ভাবমূর্তি ও অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নড়বড়ে করার ইঙ্গিত হতে পারে।’
ফায়ার সার্ভিসের আরেক সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শহিদউল্লাহ বলেন, ‘ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতার আলামত থাকতে পারে। শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন নেভানোর সবকিছু থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক। সম্প্রতি যেভাবে একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে, তাতে দেশের অর্থনীতি দুর্বল করার কোনো পাঁয়তারা চলছে কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। দুর্ঘটনার আড়ালে নাশকতা লুকিয়ে থাকতে পারে।’
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ওমর ফারুক বলেন, ‘সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো কেবল দুর্ঘটনা নয়, বরং এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাশকতা। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কেন্দ্র করেই এসব ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার উদ্দেশ্যে এসব নাশকতা সংঘটিত হচ্ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেও এসব ঘটতে পারে। শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও প্রভাব এসব ঘটনায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ওমর ফারুক বলেন, ‘এ পর্যন্ত যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। অগ্নিসংযোগ কেবল সম্পদের ক্ষতি নয়, এটি মানব হত্যার শামিল একটি গুরুতর অপরাধ। এমন অপরাধ জনজীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।’
যদি ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকতো, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা হতো না। এমন কোনো ব্যবস্থা আমরা পাইনি। ভবিষ্যতে এখানে এ ধরনের সিস্টেম স্থাপন করা জরুরি।- ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী
তার মতে, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। যারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের শনাক্ত করে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ অপরাধ বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ ইন্টেলিজেন্স কার্যক্রম পরিচালনা করলে আগেভাগেই এ ধরনের নাশকতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।’
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের কাস্টমস হাউজের অংশে আগুনের সূত্রপাত। ভবনটি বিভিন্ন ছোট ছোট কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা ছিল এবং ভেতরে প্রচুর দাহ্য (কম্বাসেবল) ও হ্যাজার্ডাস উপাদান ছিল। এজন্য অকুপেন্সি লোড অনেক বেশি ছিল এবং এ কারণেই আগুন নির্বাপণে অনেক বেশি সময় লেগেছে। যদি ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকতো, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা হতো না। এমন কোনো ব্যবস্থা আমরা পাইনি। ভবিষ্যতে এখানে এ ধরনের সিস্টেম স্থাপন করা জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে, তা তদন্তাধীন। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা বিস্তারিত যাচাই করে প্রতিবেদন দেবেন।