সোমবার, 20 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

জামায়াতের ওপর হঠাৎ এনসিপির তোপ, বিএনপির প্রতিও বিরাগ

 

স্টাফ রিপোর্টার : একটি বক্তব্যের জন্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানোর পরদিন গতকাল রোববার জামায়াতে ইসলামীর চলমান আন্দোলনকে প্রতারণা বলে আখ্যা দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। জামায়াত এই বক্তব্যকে ‘বালখিল্য’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

জুলাই সনদ স্বাক্ষর এবং এর বাস্তবায়ন নিয়ে মতভিন্নতা থেকে এনসিপির এমন প্রতিক্রিয়া বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতসহ ২৫টি দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করেনি।


জামায়াত ও এনসিপি সূত্র জানায়, এনসিপি চেয়েছিল জামায়াতও যেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করে। সে অনুযায়ী দলটির সঙ্গে একাধিকবার আলোচনাও করেছে তারা। এনসিপির জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্তকে জামায়াত সরকার ও বিএনপির ওপর ‘চাপ রাখার কৌশল’ হিসেবে সমর্থন দেয়। কিন্তু জামায়াত নিজে এই ‘চাপ-কৌশলে’ যুক্ত হতে রাজি হয়নি।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে এনসিপির গণপরিষদ গঠনের দাবিকে জামায়াত সমর্থন করে না। আবার জামায়াতের নিম্নকক্ষে পিআরের দাবিকে এনসিপি সমর্থন করে না। এই মতপার্থক্য নিয়েও দুদল এতদিন কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর সংলাপের সময় কার্যত জামায়াতকে সমর্থন দিয়ে আসছিল এনসিপি।

এনসিপি নেতারা বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে তারা বিএনপির ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। এ নিয়ে তাদের উষ্মার প্রকাশ ঘটেছে নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে। সনদ স্বাক্ষরের দিন ‘জুলাইযোদ্ধা’দের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদের একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সংসদ ভবনের সামনে আহত জুলাইযোদ্ধাদের তিনি (সালাহউদ্দিন আহমেদ) ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অনুসারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করে আহত যোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘যেসব বিশৃঙ্খলা হয়েছে, ... দেখা গেছে, এখানে জুলাইযোদ্ধাদের নামে কিছু সংখ্যক ছাত্র নামধারী উচ্ছৃঙ্খল লোক ঢুকেছে। সেটা ফ্যাসিস্ট সরকারের ফ্যাসিস্ট বাহিনী বলে মনে করি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা বিভিন্ন ফাঁকফোকরে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করছে। এখানে কোনো সঠিক জুলাই বা অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কেউ থাকতে পারে না।’

এনসিপির ক্ষমা চাওয়ার জবাবে গতকাল সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিএনপিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপরীতে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা হচ্ছে। এটা সফল হবে না।

অবশ্য তিন দলের নেতারাই জানিয়েছেন, সনদ নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানের কারণে যে মতভিন্নতা আছে, তার সঙ্গে আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতা বা জোট গঠনের সম্পর্ক নেই। নির্বাচনী সমঝোতার পথ সবার জন্য খোলা আছে।

জামায়াতের ওপর তোপ দাগলেন নাহিদ

গতকাল ফেসবুকে এক পোস্টে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর কথিত সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) আন্দোলন একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া এবং জাতীয় সংলাপকে গণঅভ্যুত্থানের আলোকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রকৃত প্রশ্ন থেকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে এটা করা হচ্ছে।

সংবিধানের একটি সুরক্ষা হিসেবেই ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মৌলিক সংস্কারের অন্যতম দাবি ছিল বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা এ ধরনের মৌলিক সংস্কার এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো তৈরি করার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামায়াত এবং তার সহযোগীরা এটা ছিনতাই করেছে। তারা একে একটি কাঠামোগত পিআর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে এবং এটাকে তাদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

জামায়াতে ইসলামী জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি বলে অভিযোগ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, তারা কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।

জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ঐকমত্য কমিশনের অধীনে সংস্কারের বিষয়ে তারা আকস্মিক যে অনুমোদন দিয়েছে, সেটা সংস্কার আকাঙ্ক্ষার ফল নয়; বরং একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ। সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে একটি রাজনৈতিক নাশকতা।

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, আজ বাংলাদেশের জনগণ এই প্রতারণা স্পষ্টভাবে বুঝে গেছে। তারা সত্যের পক্ষে জেগে উঠেছে এবং আর ভুয়া সংস্কারবাদী বা ছলনাকারীদের দ্বারা প্রতারিত হবে না।

আল্লাহ এবং এ দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণ আর কখনোই অসৎ, সুযোগসন্ধানী এবং নৈতিকভাবে দেউলিয়া শক্তিকে তাদের শাসন করার সুযোগ দেবে না বলেও লিখেছেন নাহিদ ইসলাম।

জামায়াতের প্রতিক্রিয়া

নাহিদ ইসলামের বক্তব্যকে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর দাবি করে এক বিবৃতিতে জামায়াত বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর পিআর দাবির আন্দোলনকে প্রতারণামূলক ও রাজনৈতিক কৌশল বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা ও দুঃখজনক। তাঁর কাছে এ ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।

বিবৃতিতে বলা হয়, নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের যৌক্তিক কোনো ভিত্তি নেই। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায় জামায়াত।

এনসিপির এ বক্তব্যের বিষয়ে এর আগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, সবাই যার যার আদর্শের রাজনীতি করে। জামায়াত মনে করেছে, জাতীয় স্বার্থে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা উচিত, তাই করেছে। এনসিপি মনে করেছে, স্বাক্ষর করা উচিত নয়, তারা করেনি। তিনি বলেন, সংস্কারের জন্য সবচেয়ে বেশি ছাড় দিয়েছে জামায়াত। সই করলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আন্দোলনে মাঠে রয়েছে জামায়াত এবং যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা।

৩০টি রাজনৈতিক দল এবং জোটের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপের পর জুলাই সনদে গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে স্বাক্ষর করে ২৪টি দল। গতকাল স্বাক্ষর করেছে আরেকটি দল– গণফোরাম। সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে– এ প্রশ্নের সুরাহা না হওয়ায় সনদকে কাগজ আখ্যা দিয়ে এতে সই করেনি এনসিপি। জামায়াতের মতো এনসিপিরও দাবি, সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। নির্বাচনের আগে গণভোট হতে হবে।

এনসিপির অনুরোধ রাখেনি জামায়াত

জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, সনদ স্বাক্ষরের আগের দিন এনসিপি নেতারা জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ও হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে দেখা করেন। তারা সনদে স্বাক্ষর না করতে জামায়াতকে অনুরোধ করেছিলেন।

জামায়াতের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, বাস্তবায়ন পদ্ধতি ছাড়া সনদ অপূর্ণাঙ্গ; এনসিপির এ অবস্থানের সঙ্গে জামায়াত একমত। কিন্তু এনসিপির মতো জামায়াতও স্বাক্ষর না করলে সনদের গুরুত্ব থাকত না। এ কারণেই জামায়াত সনদে সই করেছে।

পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) থাকলেও যেসব সংস্কারে সব দল একমত হয়েছে– যেমন প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ ১০ বছরে সীমাবদ্ধ করা, নির্বাচন কমিশন গঠনে বিরোধী দলের ভূমিকা; এগুলো অন্যান্য দলের চাপের কারণে সম্ভব হয়েছে। সনদ সই না করলে এগুলোর বাস্তবায়নও অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।

তবে এনসিপির একাধিক নেতা বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে তারা অধিকাংশ বিষয়ে জামায়াতের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দলটি বিনিময়ে কিছুই করেনি। এনসিপির প্রধান দাবি ছিল, আগামী সংসদকে গণপরিষদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে সংবিধান সংস্কার করা। জামায়াত এ দাবিকে সমর্থন করেনি। নির্বাচন এবং একই দিনে গণভোটে এনসিপির আপত্তি ছিল না। কিন্তু জামায়াতের কারণেই অবস্থান পরিবর্তন করে নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি করে এনসিপি।

পিআর থেকে টানাপোড়েন

জুলাই সনদ নিয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দল গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দুই দফা বৈঠক করে। এনসিপির উদ্যোগে এসব বৈঠক হয়। দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনে নামার আলোচনা ছিল। নাহিদ ইসলামের বাসায় গিয়েও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বৈঠক করেন বলে সূত্র জানায়।

মধ্য সেপ্টেম্বরে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি দল জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নামে। এই উদ্যোগ থেকে সরে যায় এনসিপি, এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদ। দলগুলোর ভাষ্য ছিল, তারা জামায়াত এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে আন্দোলন করে ডানপন্থি তকমা পেতে চায় না। তখন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এক নেতা বলেছিলেন, অন্যদের মাঠে নামিয়ে এনসিপির সরে যাওয়াটা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে।

এনসিপি নেতারা বলছেন, আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জুলাই সনদ অনুযায়ী পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন। কিন্তু জামায়াত আন্দোলনের নেতৃত্ব কবজা করেছে। পুরো নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে আয়োজনের দাবি সামনে আনে তারা; যা জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের দলীয় দাবি।

এনসিপি শুধু উচ্চকক্ষে পিআর চায়। তাই তারা যুগপৎ আন্দোলনে থাকেনি।

গতকাল ফেসবুক পোস্টে নাহিদ লিখেছেন, তথাকথিত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) আন্দোলন, যা জামায়াতে ইসলামী শুরু করেছিল, প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল এক পরিকল্পিত রাজনৈতিক চাতুরী। ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া বানচাল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এটি হয়েছিল। জাতীয় সংলাপকে জনগণের গণঅভ্যুত্থানের আলোকে রাষ্ট্র ও সংবিধানের পুনর্গঠনের প্রকৃত প্রশ্ন থেকে সরিয়ে দিতে আন্দোলন করা হয়।

জামায়াতের হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, তরুণদের দল এনসিপি যা ইচ্ছা বলতে পারে। জামায়াত দায়িত্বশীল দল। অন্যদের বিষয়ে অযাচিত মন্তব্য করবে না। জামায়াত এমন কোনো অবস্থান নিতে পারবে না, যাতে সংস্কার ও নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়ে, সনদ মূলহীন হয়ে যায়, দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়।

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, জামায়াত প্রকাশ্যে বলেছিল আইনি ভিত্তি ছাড়া তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। গণঅধিকার পরিষদও একই কথা বলেছিল। কিন্তু তারা কেউ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। এতে প্রমাণ হয়, সংস্কারের সংলাপে অংশগ্রহণ জামায়াতের রাজনৈতিক প্রতারণা ছিল। বিএনপি ও জামায়াত ক্ষমতা ভাগাভাগির পুরোনো রাজনীতি করছে। তারা আইনি ভিত্তিহীন সনদে স্বাক্ষর করেছে। তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নের জন্য এনসিপি একাই আন্দোলন করে যাবে।

 

সর্বাধিক পঠিত