স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে লাগা আগুন সাত ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বিমানবন্দরে প্রায় ৭ ঘণ্টা পর ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ শুরু হয়েছে। রাত ৯টার পর ফ্লাই দুবাই অবতরণের মধ্যে বিমানবন্দরের অপারেশন কার্যক্রম চালু হয়। শনিবার (১৮ অক্টোবর) রাত ৯টার পর দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইট শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।
শনিবার রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম রনি।
রাত ১০টায় ঘটনাস্থলে এসে বিফ্রিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। বাড়ার আর আশঙ্কা নেই।
আগুন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে রানওয়ে প্রস্তুত করে ফ্লাইট চালু করার চেষ্টা করার কথাও বলেন তিনি।
এদিন সোয়া ২টার দিকে কার্গো কমপ্লেক্সে আগুন লাগে, যা নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিসের ৩৫টি ইউনিট।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার তথ্য দেওয়া হলেও তা এখনও নেভেনি। সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। পুরোপুরি নেভানোর চেষ্টার পাশাপাশি কার্গো ভিলেজের বাকি পণ্য যাতে নষ্ট না হয় সে চেষ্টা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রানওয়ে প্রস্তুত হওয়ায় ফ্লাইট চলাচল শুরুর অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।
রাত সাড়ে ১০টারদিকে এ রিপোর্ট লেখার সময় তিনটি ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা। বিমানবন্দরে ভিড় করে আছেন বিদেশগামী যাত্রীরা।
শাহজালাল বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের যে অংশে কুরিয়ারের কাজকর্ম চলে, শনিবার বেলা সোয়া ২টার দিকে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে কর্মীরা জানান।
ফায়ার সার্ভিসের ৩৬টি ইউনিট সেখানে আগুন নেভাতে কাজ করে। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, আনসার, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী সদস্যরাও যোগ দেন অগ্নি নির্বাপণের কাজে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সেখানে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকার তথ্য দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ থেকে যেসব ফ্লাইট ঢাকায় নামার কথা, সেগুলোকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। ঢাকায় নামতে না পেরে অন্য বিমানবন্দরে চলে যায় এক ডজনের বেশি ফ্লাইট।
ভয়াবহ এ আগুনের পর প্রথমে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ারফিল্ড শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও পরে তা রাত ৯টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শাহজালালে নামতে না পেরে আটটি ফ্লাইট চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
এর মধ্যে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ব্যাংকক থেকে ঢাকা এবং এয়ার অ্যারাবিয়ার শারজাহ থেকে ঢাকার দুটি ফ্লাইট রয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সৈয়দপুর থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণ না করে চট্টগ্রামে অবতরণ করে।
একইভাবে ইউএসবাংলা এয়ারলাইন্সের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের পর পুনরায় চট্টগ্রামে ফিরে যায়।
দিল্লি থেকে ঢাকার পথে থাকা ইন্ডিগো ফ্লাইট অবতরণ করে কলকাতায়।
ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরগামী বাটিক এয়ারের ওডি ১৬৩ ফ্লাইট এবং ঢাকা থেকে মুম্বাইগামী ইন্ডিগোর ৬ই ১১১৬ ফ্লাইট ট্যাক্সিওয়েতে অপেক্ষা করে।
হংকং থেকে ঢাকা আসা ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের বিমানটি অবতরণ না করতে পেরে অন্য বিমানবন্দরে যায়।
পরে রাত ৯টার দিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এক বার্তায় বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার খবর দেয়।
সেখানে বলা হয়, “ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে নিশ্চিত করা যাচ্ছে যে আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেছে। রাত ৯টা থেকে সব ফ্লাইট কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হবে।
“বিমানবন্দর ব্যবহারকারী যাত্রী ও সাধারণ জনগণের সহযোগিতা ও ধৈর্য ধারণের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।”
মন্ত্রণালয় বলছে, ‘দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপে’ আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো নিহতের ঘটনা ঘটেনি।
এরপর রাত ৯টা ৬ মিনিটে প্রথম ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার তথ্য দেয় শাহজালাল কর্তৃপক্ষ। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কয়েকটি ফ্লাইট ওঠানামা করতে দেখা গেছে।
এর আগে দুপুর ২টার আশেপাশে লাগা বিমানবন্দরে ইতিহাসের ভয়াবহ এই আগুন নিয়ন্ত্রণে একে একে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ টি ইউনিট। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী সদস্যরাও যোগ দেন অগ্নি নির্বাপণের কাজে।
তবে কীভাবে সেখানে আগুন লেগেছে তা কর্তৃপক্ষ এখনও জানাতে পারেনি। সেখানে কর্তব্যরত অন্তত ২৫ জন আনসার সদস্য আহত হয়েছেন, যাদের সিএমএইচ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বিমানবন্দরের পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে কার্গো ভিলেজের যে অংশে আগুন লেগেছে সেখানে আমদানি করা পণ্য মজুত রাখা হয়।
বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন এতটাই ভয়াবহ যে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়।
কারগো ভিলেজ এ মাথা থেকেও মাথা লম্বায় আনুমানিক ৩০০ মিটার। বিমানবন্দরটির উত্তর-পূর্ব কোনায় এটি অবস্থিত।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের যেই অংশে কুরিয়ারের কাজকর্ম চলে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মীরা।
শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও কুরিয়ার শাখায় আধাবেলা পর্যন্ত কাজকর্ম চলে।
এয়ারপোর্ট কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলছেন, ২টার দিকে তাদের লোকজন বের হয়ে যাওয়ার পরপর আগুনটা লাগে।
“সেখানে তখনো অনেক শ্রমিক, আনসারসহ লোকজন ছিল। কিন্তু আগুন লাগার পর আনসারসহ অন্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয় এই গুদামে গোলাবারুদসহ কেমিকেল রয়েছে, ব্লাস্ট হতে পারে। সবাই সরে যান।”
মিঠু অভিযোগ করেন, “আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ৮ নাম্বার গেটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিল না।”
বিমানের তিনজন কর্মী বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা বলছেন, কুরিয়ার শাখা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর তারা দৌড় দিয়ে বের হয়ে আসেন।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনাকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় ব্যর্থতা’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলম। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘এই ব্যর্থতার ফল বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এগুলো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নাটক বন্ধ করে এর পেছনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)–এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘নাশকতার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই তদন্ত করে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে। তবে দেশে রাসায়নিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক অসতর্কতা সর্বত্র বিদ্যমান। এর প্রমাণই হলো সাম্প্রতিক এই অগ্নিকাণ্ডগুলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘একই সময়ে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনায় আমরা নাশকতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারি না। সামগ্রিকভাবে মানুষের নিরাপত্তা-বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ ও আশপাশের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রতি আমাদের সম্মান ও দায়বদ্ধতা খুবই কম।’
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘রাসায়নিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। নিয়মিত পরিদর্শন নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও তা যথাযথভাবে হয় না। দায়ীদের বিরুদ্ধে কী আইনি শাস্তির বিধান আছে, কিংবা আগের ঘটনার বিচার হয়েছে কিনা? হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনের দুর্বলতা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জবাবদিহির অভাবেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। আইনের সংস্কার ও বিচারের নিশ্চয়তা না থাকলে এই অগ্নিকাণ্ডের ধারা বন্ধ হবে না।’
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘দুর্ঘটনা কিংবা নাশকতা-কোনোটিকেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুদিন পরপরই দেশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। টঙ্গি, মিরপুর, চট্টগ্রাম এবং সর্বশেষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ইপিজেড ও বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যেগুলো কেপিআই হিসেবে পরিচিত।’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের স্থাপনায় উন্নতমানের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম থাকার কথা। যদি এমন ব্যবস্থা সত্যিই থাকে, তাহলে সেটি কার্যকর হলো না কেন? ফায়ার টিম থাকার কথা, তারা কেন আগুন লাগার পরও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেনি?’
মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ আরও বলেন, ‘বিমানবন্দর এলাকায় সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব দুটি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। মাত্র ৫০ থেকে ১০০ গজ দূরে। তারা কি সময়মতো সংবাদ পেয়েছিল? পেলে তারা সঠিকভাবে রেসপন্স করতে পারল না কেন? আর আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল কেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘ওই স্থাপনায় কর্মরত ব্যক্তি বা মালামালের মালিকদের মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল কি না, দেনা-পাওনা নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল কি না, সেগুলোও তদন্তের আওতায় আনা উচিত। কারণ এয়ারপোর্টে হাজার হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে। সেখানেও স্বার্থ সংঘাতের সম্ভাবনা থাকতে পারে।’ ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পুরো সিস্টেমের কোথাও কোনও গলদ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিমানবন্দর এলাকায় দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থাই সক্রিয়, তারা কোনও আগাম তথ্য পেয়েছিল কি না। আর পেলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল কি না- এই বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা জরুরি।’
শনিবার সন্ধ্যার পর বাণিজ্য এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন লাগার স্থান পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কী কারণে আগুন লেগেছে সেটা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করা হবে। তার আগে আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত ফ্লাইট ওপেন করা।’
এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গভীরভাবে অবগত রয়েছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বলেও জানিয়েছে সরকার।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনাকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় ব্যর্থতা’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলম। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘এই ব্যর্থতার ফল বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এগুলো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নাটক বন্ধ করে এর পেছনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)–এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নাশকতার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই তদন্ত করে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে। তবে দেশে রাসায়নিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক অসতর্কতা সর্বত্র বিদ্যমান। এর প্রমাণই হলো সাম্প্রতিক এই অগ্নিকাণ্ডগুলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘একই সময়ে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনায় আমরা নাশকতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারি না। সামগ্রিকভাবে মানুষের নিরাপত্তা-বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ ও আশপাশের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রতি আমাদের সম্মান ও দায়বদ্ধতা খুবই কম।’
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘রাসায়নিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। নিয়মিত পরিদর্শন নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও তা যথাযথভাবে হয় না। দায়ীদের বিরুদ্ধে কী আইনি শাস্তির বিধান আছে, কিংবা আগের ঘটনার বিচার হয়েছে কিনা? হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনের দুর্বলতা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জবাবদিহির অভাবেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। আইনের সংস্কার ও বিচারের নিশ্চয়তা না থাকলে এই অগ্নিকাণ্ডের ধারা বন্ধ হবে না।’
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্ঘটনা কিংবা নাশকতা-কোনোটিকেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুদিন পরপরই দেশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। টঙ্গি, মিরপুর, চট্টগ্রাম এবং সর্বশেষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ইপিজেড ও বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যেগুলো কেপিআই হিসেবে পরিচিত।’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের স্থাপনায় উন্নতমানের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম থাকার কথা। যদি এমন ব্যবস্থা সত্যিই থাকে, তাহলে সেটি কার্যকর হলো না কেন? ফায়ার টিম থাকার কথা, তারা কেন আগুন লাগার পরও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেনি?’
মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ আরও বলেন, ‘বিমানবন্দর এলাকায় সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব দুটি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। মাত্র ৫০ থেকে ১০০ গজ দূরে। তারা কি সময়মতো সংবাদ পেয়েছিল? পেলে তারা সঠিকভাবে রেসপন্স করতে পারল না কেন? আর আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল কেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘ওই স্থাপনায় কর্মরত ব্যক্তি বা মালামালের মালিকদের মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল কি না, দেনা-পাওনা নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল কি না, সেগুলোও তদন্তের আওতায় আনা উচিত। কারণ এয়ারপোর্টে হাজার হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে। সেখানেও স্বার্থ সংঘাতের সম্ভাবনা থাকতে পারে।’
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পুরো সিস্টেমের কোথাও কোনও গলদ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিমানবন্দর এলাকায় দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থাই সক্রিয়, তারা কোনও আগাম তথ্য পেয়েছিল কি না। আর পেলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল কি না- এই বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা জরুরি।’
শনিবার সন্ধ্যার পর বাণিজ্য এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন লাগার স্থান পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কী কারণে আগুন লেগেছে সেটা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করা হবে। তার আগে আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত ফ্লাইট ওপেন করা।’
এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গভীরভাবে অবগত রয়েছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বলেও জানিয়েছে সরকার।