বুধবার, 15 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

অগ্নিঝুঁকিতে রাজধানী বদলায় না বাস্তবতা


স্টাফ রিপোর্টার : পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি অলিগলিতে এখনো কেমিক্যালের গন্ধ। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডির পরও থামেনি আগুনের ভয়। ডিএসসিসির হিসাবেই এখনো দুই হাজারের বেশি কেমিক্যাল কারখানা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর পাশে বসবাস করছে লাখো মানুষ।


যেকোনো মুহূর্তে আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, রাজধানীতে দুই হাজার ৬০০ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে, যার মধ্যে এক হাজারের বেশি বিপণিবিতান আছে। অনুমোদিত নকশায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও ভবন মালিকরা তা বাস্তবায়ন করেন না।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর এলাকাবাসী পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম উচ্ছেদের দাবিতে আন্দোলনে নামে।


কিছু সময় প্রশাসন তৎপর হলেও পরে অভিযান থেমে যায়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গুদামে বিস্ফোরণে ৭১ জনের মৃত্যু ঘটে। সেই দুর্ঘটনার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) একটি টাস্কফোর্স গঠন করে এবং মাত্র ৩৩ দিন অভিযান চালিয়ে ১৭০টি কেমিক্যাল গুদাম সিলগালা করে। এরপর সেই অভিযান আর এগোয়নি।

পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বঙ্গবাজারের পর সর্বশেষ রাজধানীর অগ্নি ট্র্যাজেডির খাতায় যুক্ত হয়েছিল বেইলি রোড। গত প্রায় দেড় যুগে আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২৬৮ জনের। অন্যদিকে মগবাজারে ভবনে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। প্রতিবার আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে সরকার।


আশ্বাস দেওয়া হয় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু বদলায় না কিছুই। এসবের জন্য ক্ষমতা, প্রভাব ও বিত্তশালীদের অসততা দায়ী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
স্থানীয় লোকজন বলছে, পুরান ঢাকার অলিগলিতে এখনো রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা, ৭০ শতাংশ সড়ক অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী। অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও সরু গলির পুরান ঢাকা বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এই এলাকার মোড়ে মোড়ে এখনো রাসায়নিক গুদাম ও প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। এর বেশির ভাগই অবৈধ। এসব স্থানে সামান্য আগুনও বাসিন্দাদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এখনো পুরান ঢাকায় প্রায় আড়াই হাজার কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে, যেগুলো দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্ত। এসব গুদামের পাশে লাখো মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। লালবাগ, চকবাজার, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড—সবখানেই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম।

ব্যবসায়ীরা বরাবরই গুদামের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এলেও বাস্তবতা ভিন্ন। কিছু গুদাম কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে ঠিকই, তবে বেশির ভাগ গুদাম এখনো পুরান ঢাকায় রয়ে গেছে। ডিএসসিসির ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় এক হাজার ৯২৪ জন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই সংখ্যা বর্তমানে আরো বাড়তে পারে।

ডিএসসিসির স্থপতি ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সড়ক প্রশস্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় করপোরেশনের আলাদা একটি উইংও রয়েছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’ আর জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (চলতি দায়িত্ব) মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘রাজধানীতে রাজউকের কাছ থেকে সাধারণত যেসব বিল্ডিং অনুমোদন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো আমাদের এনলিস্টেড সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের ডিজাইনে তৈরি করা। এর বাইরে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা অন্য কোনো জায়গা থেকে যদি অনুমোদন নিয়ে থাকে, তাহলে ভবনটিতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে কি না এবং সেখানে ফায়ার সেফটি মেইনটেইন করা হয়েছে কি না—এই ধরনের কোনো তথ্য রাজউকের কাছে নেই।’

তিনি বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষ যখন কোনো ভবন ভিজিট করবে বা বিল্ডিং ভাড়া নেবে, তারা তো জানার অধিকার রাখে যে এই বিল্ডিং নিয়মমাফিক গড়ে উঠেছে কি না, দুর্যোগ সহনীয় কি না বা ভবনে কোনো ঝুঁকি আছে কি না। আমরা শুধু অগ্নিদুর্ঘটনা দেখি, কিন্তু আরো বড় ঝুঁকি রয়েছে। রাজউক এসব বিষয়ে কাজ করছে।’

পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘শহরটা যেভাবে চলছে এটা তো কোনো সিস্টেমের মধ্যে পড়ছে না। পুরান ঢাকার ৭০ শতাংশ রাস্তাই ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি তো নয়ই, ছোট গাড়ি চলাচলেরও উপযুক্ত নয়। তাই ছোট-বড় দুর্ঘটনাও সামাল দেওয়ার মতো অবস্থা আমাদের সংস্থাগুলোর নেই। এই শহর যেকোনো সময় একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে।’

ফায়ার সার্ভিসের হালনাগাদ তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকায় দুই হাজার ৬০০ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ১০৬টি বিপণিবিতান। তালিকায় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভবন। ফায়ার সার্ভিস ঢাকার সব ভবন পরিদর্শন করতে পারেনি। ফলে রাজধানীতে মোট কত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানা সম্ভব নয়। পরিদর্শনে ফায়ার সার্ভিস অগ্নিঝুঁকির দিক দিয়ে দুটি শ্রেণিতে ভবনগুলোকে ভাগ করে। ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিঝুঁকি কমাতে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ নামে ২০০৩ সালে একটি আইন করা হয়। ওই আইনে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তির ছাড়পত্র নিতে হয়। ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান, গাড়ি ঢুকতে পারবে কি না—এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ছাড়পত্রটি দেয় ফায়ার সার্ভিস। তারপর এই ছাড়পত্র দেখিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে ভবনের নকশার অনুমোদন নিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে হয়।

অবশ্য ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবন নির্মাণের পর বেশির ভাগ মালিক বা কর্তৃপক্ষ ফায়ার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন না। ভবন নির্মাণের আগে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়, পরে সেটি বাস্তবায়ন করা হয় না বলেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন না।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার (মিডিয়া সেল) মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, ‌‌‘ফায়ার সার্ভিস কেমিক্যাল ব্যবসার অনুমোদন দেয় না। চুড়িহাট্টার মতো অগ্নিদুর্ঘটনার পর অভিযান করা হয়েছে। এখন প্রকাশ্যে কেমিক্যাল ব্যবসা চলছে না। শুধু সরকারি সংস্থার তদারকিতে ঝুঁকি কমানো কঠিন। অবশ্যই স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতা এখানে বড় বিষয়।

 

সর্বাধিক পঠিত