স্টাফ রিপোর্টার : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘরোয়া প্রস্তুতি জোরেশোরে এগিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। চলছে আসন চূড়ান্ত করার কাজ। পাশাপাশি চলছে আসনভিত্তিক দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রক্রিয়াও। প্রার্থী হওয়ার আশায় আগ্রহীরা ছুটাছুটি করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বাসায় ও অফিসে। ইতোমধ্যে দলের নীতিনির্ধারকরা প্রত্যেকে একটি আসনে নির্বাচনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
স্থায়ী কমিটির সূত্রগুলো জানিয়েছে, এবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে শুরু করে প্রত্যেক নেতার জন্যই একটি আসন বরাদ্দ করা হচ্ছে। বিগত নির্বাচনগুলোতে দলের শীর্ষ নেতারা দুই-তিন এমনকি বেগম খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রার্থিতা করলেও আগামী নির্বাচন থেকে সেই চিত্র আর দেখা যাচ্ছে না।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ একজন জানিয়েছেন, স্বয়ং তারেক রহমান বগুড়ার একটি আসন থেকে নির্বাচন করবেন। এছাড়া বিগত নির্বাচনে দুই আসনে প্রার্থিতা করা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও একটি আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
স্থায়ী কমিটির সূত্র জানায়, বিগত সময়ে স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্যরা একাধিক আসনে দলীয় মনোনয়ন লাভ করতেন। এ বছর আর এই সুযোগ থাকছে না।
কয়েকজন দায়িত্বশীল সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ এবার প্রার্থিতাও করছেন না। এর মধ্যে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও নজরুল ইসলাম খান অন্যতম।
স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে তারেক রহমান বগুড়ার একটি আসন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুগাঁওয়ের একটি, মির্জা আব্বাস ঢাকার একটি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় একটি, ড. আব্দুল মঈন খান নরসিংদীর একটি, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামের একটি, সালাহ উদ্দিন আহমেদ কক্সবাজারের একটি আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
এছাড়া ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জের একটি আসন, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন দিনাজপুর-৬ আসনে, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ভোলার একটি আসন থেকে প্রার্থিতা করবেন। সেলিমা রহমান সংরক্ষিত আসন থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন সদস্য দুটি করে আসনে প্রার্থিতা করার ইচ্ছা পোষণ করলেও বিএনপির এবারের পলিসিতে এই সুযোগ নেই।
কমিটির অন্যতম একজন সদস্য বলেন, ‘তারেক রহমান নিজেই একটি আসন থেকে প্রার্থিতা করে উদাহরণ সৃষ্টি করবেন। এটি ভবিষ্যতে রাজনীতি ও নির্বাচনের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।’
যদিও দলের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বগুড়া-৭, ঢাকা-৫, ঢাকা-৯, ফেনী-১ ও চট্টগ্রাম-৮ থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বগুড়া-৬, বগুড়া-৭, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২ ও চট্টগ্রাম-১ থেকে নির্বাচন করে জয়ী হন তিনি।
২০০১ সালের নির্বাচনেও তিনি চট্টগ্রাম-১ বাদ দিয়ে খুলনা-২ থেকে নির্বাচন করেন। এছাড়া বাকি চারটিতেও তিনি জয়লাভ করেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বগুড়া-৬, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১ থেকে নির্বাচন করেন জয়লাভ করেন। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচন তিনি বর্জন করেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে কারাবন্দি ছিলেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, এবারও দলের একটি অংশে ও চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ মহলে খালেদা জিয়ার নির্বাচন করার আলোচনা চালু আছে। খালেদা জিয়া স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে দূরে থাকলেও অনেকেই জোর ধারণা করছেন—তিনি এবারও নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। তবে তা কতখানি বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা আছে।
স্থায়ী কমিটির একটি প্রভাবশালী সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তার শারীরিক সক্ষমতা অনেক কম। মানসিকভাবে দৃঢ় থাকলেও নির্বাচনে মুভ করার মতো অবস্থায় তিনি নেই।
আরেকজন সদস্যের ভাষ্য, বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন ফেনী এলাকার একটি আসন থেকে। তিনি নির্বাচনি প্রচারণায়ও অংশ নিতে পারেন।
চেয়ারপারসনের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে খালেদা জিয়া সব সময় সোচ্চার। তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বরাবরই আগ্রহী। সর্বশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারাগারে থাকার সময়ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রক্রিয়া করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে দলের একটি প্রভাবশালী পক্ষও বেগম জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে।
এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে কারও কারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
সম্প্রতি তারেক রহমানও বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
কোনও কোনও সদস্য জানান, নির্বাচনে আগ্রহীদের মধ্যে এক পরিবার থেকে একজনকেই প্রার্থিতার সুযোগ দেবে বিএনপি। একই পরিবার থেকে দুই জনকে মনোনয়ন না দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান এই সদস্যরা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘দেখুন, বিএনপি ও যুগপতে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। যারা যুগপতে ছিল তাদেরও আসন দিতে হবে। আমরা নিজেরাও চেষ্টা করছি, যেন সবাই এক আসনে একজন হিসেবে কাজ করেন। তবে মূল নেতৃত্ব আলাদা।’
দলের চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারা কী করবেন, সেটা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে উল্লেখ করেন সেলিমা রহমান।
বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিমা রহমান বলেন, ‘ওইটা তো নির্ভর করে ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার ওপর। তিনি আমাদের দেশের এমন এক নেত্রী, আমরাও চাইবো তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। তিনি সুস্থ থাকলে নির্বাচনের মাঠে আমরা তাকে দেখতে চাই। কিন্তু আমাদের তো অনেক কিছু চিন্তা করতে হবে।’
ইসির এক কর্মকর্তা জানান, আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২) এখনও আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য আছে। চূড়ান্ত হয়ে আসেনি। চূড়ান্ত হয়ে এলে বুঝা যাবে—একজন প্রার্থী কয়টি আসনে প্রার্থিতা করতে পারবে। এখন পর্যন্ত আগের নিয়মেই আছে।
উল্লেখ্য, পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রার্থী তিনটি আসন থেকে প্রার্থিতা করতে পারতেন।
প্রার্থীদের সবুজ সংকেত দিচ্ছেন তারেক রহমান
দলীয় ফোরামে এখনও প্রার্থিতা নির্ধারণ না হলেও কিছু কিছু আসনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিতে শুরু করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র সোমবার (৬ অক্টোবর) বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদককে জানায়, ইতোমধ্যে ঢাকার দুটি আসনে আন্দালিভ রহমান পার্থ, ববি হাজ্জাজকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। মনোনয়নের ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক এক সভাপতি।
এ বিষয়ে সোমবার (৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, ‘আরে এখনও এরকম কিছু কনফার্ম না। সবই আলাপের মধ্যে আছে।’
তবে ভোলার আসন থেকেও নির্বাচন করবেন বলে জানান পার্থ। দুটি আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলেও উল্লেখ করেন পার্থ।
পার্থ জানান, নির্বাচন যুগপৎ ধারাতেই হবে।
দলের একজন সিনিয়র নেতা জানান, ইতোমধ্যে বিভিন্ন দল ও জোটকে নির্বাচনের প্রার্থিতার তালিকা দিতে বলা হয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চ সোমবার বৈঠক করেছে আসন নির্ধারণের জন্য। তাদের একটি তালিকা বিএনপির কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো নিয়ে আমরা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। সবই আলোচনার পর্যায়ে আছে। আরও কিছু দিন সময় লাগবে।