স্টাফ রিপোর্টার : দেশের বিভিন্ন স্থানের বেহাল ১৪০টি থানা, পুলিশ ফাঁড়ি/তদন্ত কেন্দ্র, ক্যাম্প, নৌ-পুলিশ কেন্দ্র, রেলওয়ে পুলিশ থানা, আউটপোস্ট, ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টার ও হাইওয়ে পুলিশের আউটপোস্ট নতুন রূপে ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জরুরি এ সংস্কারে ব্যয় হবে ৭০৭ কোটি ৫৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৮ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় বাংলাদেশ পুলিশ।
২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে পাঁচ শতাধিক থানা পোড়ানো-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে কিছু থানা রেভিনিউ বাজেটের আওতায় সংস্কার করা হয়েছে। কিছু থানার অবস্থা বয়সজনিত কারণেও বেহাল। কিছু কিছু পুলিশ ক্যাম্পও জুলাই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুষ্ঠু সেবা দিতে এগুলোর সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।
অনেক ক্যাম্প-ফাঁড়ি অস্থায়ীভাবে নির্মিত। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, স্কুল, পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ ভবন ও ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। কাজেই মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় এগুলোর নির্মাণকাজ অতি জরুরি বলে দাবি করে বাংলাদেশ পুলিশ।
১৪০টি পুলিশ ফাঁড়ি ক্যাম্প সংস্কারের একটি প্রকল্প আমাদের কাছে এসেছে। প্রকল্প নিয়ে পিইসি সভা হয়েছে। তাদের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কোনো অসংগতি আছে কি না দেখছি।- অতিরিক্ত সচিব ড. শাহ্ মো. হেলাল উদ্দীন
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক- এআইজি (বাস্তবায়ন-উন্নয়ন) ড. মো. মনজুর আলম প্রামাণিক বলেন, ‘দেশের নানান স্থানের ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্র, ক্যাম্প, নৌ-পুলিশ কেন্দ্র, রেলওয়ে পুলিশ থানা ও আউটপোস্ট, ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টার এবং হাইওয়ে পুলিশের আউটপোস্টের অবস্থা ভালো নয়। এগুলো সংস্কার জরুরি। সেজন্য আমরা ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পের যাচাই-বাছাই শেষ ধাপে। ১৪০টির মধ্যে ২০টি রেলের জমিতে হবে। সেই জমিও আমরা পেয়ে গেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে কিছু থানার ক্ষতি হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে থেকেও কিছু সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে।’
যে কারণে সংস্কার জরুরি
বাংলাদেশ পুলিশ আরও জনায়, থানা ও তদন্ত কেন্দ্রের মতো পুলিশ ক্যাম্প-ফাঁড়িগুলোও জরুরি প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ, বিদেশি নাগরিকদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং, নিরাপত্তা এবং কেপিআইগুলোর নিরাপত্তায় ক্যাম্প/ফাঁড়িগুলোর গুরুত্ব বেড়েই চলছে। এগুলোর অধিকাংশই ক্ষণস্থায়ীভাবে তৈরি। ভাড়া বাড়ি কিংবা জরাজীর্ণ ভবনে এগুলোর কার্যক্রম কোনো রকমে পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়া বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তা জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ও বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন সড়ক ও জনপদগুলোতে মানুষ চলাচল, পণ্য পরিবহন আগের তুলনায় অনেকাংশে বেড়েছে। কিন্তু যথাযথ ভৌত অবকাঠামো, অফিস ও যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন।
রেল পুলিশ
বিদ্যমান রেল পুলিশের থানা ও ফাঁড়িগুলো জরাজীর্ণ। আগে রেলের থানা ফাঁড়ির জন্য কোনো ভবন না থাকায় রেলস্টেশনে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম পরিচালিত হতো। জনবল বাড়ায় রেল পুলিশে কর্মরত জনবলের আবাসন ও নিরাপত্তার জন্য নতুন স্থাপনা নির্মাণ এবং সংস্কার জরুরি।
ট্যুরিস্ট পুলিশ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ট্যুরিস্ট পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশে দিন দিন পর্যটন প্রসারিত হচ্ছে। পর্যটনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরের কর্মপরিধি দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু সীমিত অবকাঠামো ও লজিস্টিক দিয়ে পর্যটন শিল্পের এ বিকাশমান অগ্রযাত্রার সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে ট্যুরিস্ট পুলিশকে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চারতলা ভিতবিশিষ্টি চার হাজার ২শ বর্গফুট আয়তনের দোতলা ফাঁড়ি ও ক্যাম্প নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশ
সড়ক দুর্ঘটনা, সড়কে ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ফিটনেসবিহীন ও অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে হাইওয়ে পুলিশকে ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু যথাযথ ভৌত অবকাঠামো, অফিস ও যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবায় বিঘ্ন ঘটছে। এজন্য হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন।
নৌ-পুলিশ
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়- নৌ-পথে সংঘটিত অপরাধ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ডাকাত থেকে যাত্রী ও মালামাল রক্ষা করা নৌ-পুলিশের কাজ। এছাড়া অধিক যাত্রী ও অবৈধ মালামাল বহনের বিরুদ্ধে টহল দেওয়া, ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করছে নৌ-পুলিশ। কিন্তু যথাযথ অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। অফিস, যানবাহনসহ লজিস্টিক স্বল্পতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। এজন্য নৌ-পুলিশের অবকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়নের বিকল্প নেই।
প্রকল্পের ব্যয়
প্রকল্পের আওতায় মোট এক লাখ ২৯ হাজার ৬৩৫ বর্গমিটার নির্মাণ ও পূর্তকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৬৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
প্রকল্পের আওতায় ১৪০টি পুলিশ-ফাঁড়ির আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র ফাঁড়ি, ক্যাম্প ও তদন্ত কেন্দ্র, নৌ-পুলিশ কেন্দ্র, রেলওয়ে পুলিংশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ এবং ইমিগ্রেশন পুলিশের জন্য ফাঁড়ি, ক্যাম্প চেকপোস্টের আসবাবপত্র কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ কোটি টাকা। সঙ্গে আছে অন্য ব্যয়।
প্রকল্পের ত্রুটি
প্রস্তাবিত প্রকল্পের কিছু ত্রুটি পেয়েছে কমিশন। ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী পিইসি সভার কার্যবিবরণী প্রাপ্তির ২০ কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগ পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে হবে। কিন্তু ৯ মাস পরে সংশ্লিষ্ট বিভাগ পুনর্গঠিত ডিপিপি কমিশনে পাঠিয়েছে। সংস্থার কাছে এ বিলম্বের ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছে কমিশন।
প্রকল্পের প্রস্তাবিত ভবনের আয়তন, প্রাধিকার অনুযায়ী প্রাপ্যতা, ফ্লোর ইউজ প্ল্যান, ভবন নির্মাণ বাবদ ব্যয়, ব্যয় নির্ধারণের ভিত্তি, যৌক্তিকতা প্রভৃতি বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের মতামত চাওয়া যেতে পারে। রেলওয়ে পুলিশ থানা নির্মাণের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের সম্মতিপত্র ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংযুক্ত থাকলেও তা অস্পষ্ট ও পঠনযোগ্য নয়। এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট পত্র ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপনের জন্য সংস্থাকে জানানো যেতে পারে বলে জানায় কমিশন।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতায় একই ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংস্থার কাছে জানতে চাওয়া যেতে পারে। আলোচ্য প্রকল্পে স্থাপত্য নকশা অঙ্গ ও কাঠামো নকশা অঙ্গে মোট ২৮ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কতটি কম্পিউটার কাদের জন্য কেনা হবে, কম্পিউটারের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন ও ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রকল্পের জন্য কোনো প্রকল্প পরিচালক-উপ-প্রকল্প পরিচালক প্রস্তাব করা হয়নি। এক্ষেত্রে কর্মকর্তারা প্রেষণে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলে এত বড় পরিসরের প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাহত হবে কি না তা সংস্থার কাছে জানতে চাওয়া যেতে পারে বলে উল্লেখ করে কমিশন।
প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন উইং-১ এর প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) ড. শাহ্ মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘১৪০টি পুলিশ-ফাঁড়ি ক্যাম্প সংস্কারের একটি প্রকল্প আমাদের কাছে এসেছে। প্রকল্প নিয়ে পিইসি সভা হয়েছে। তাদের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কোনো অসংগতি আছে কি না দেখছি। এছাড়া যেসব পুলিশ-ক্যাম্প সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে সেই সব লোকেশন দেখছি। সবগুলো বিবেচনা করেই ডিপিপি চূড়ান্ত করা হবে। প্রকল্পের সামগ্রিক বিষয় একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।’
জুলাই আগস্টে ক্ষতিগ্রস্ত পুলিশ-ক্যাম্প সংস্কারের কথা প্রকল্পে বলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘বিষয়টি থাকার কথা, তবে না দেখে বলা যাবে না।’