স্টাফ রিপোর্টার : সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছু আর্থিক সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে আরেকটি বেতন কাঠামো হচ্ছে। বকেয়া ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। এদিকে রাজস্ব আয়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় বাড়তি ব্যয়ের অর্থসংস্থান নিয়ে চিন্তায় সরকার। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বরে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সংশোধন হবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনার মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। ভাতায় রয়েছে ৪১ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বেতন-ভাতা খাতে মোট বরাদ্দ ৮৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে বেতন-ভাতায় আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর ফলে এ খাতে বরাদ্দ আরও কিছুটা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। তবে কিছু বাড়তি খরচের হিসাব পাওয়া গেলেও সার্বিকভাবে কত ব্যয় বাড়বে– তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার অগ্রাধিকার নির্ধারণের কাজ করছে। কোনো খাতে ব্যয় সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে কিনা, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে সংশোধিত বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যাবে। সাধারণত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষ করে মার্চে সরকার জাতীয় বাজেট সংশোধন করে। তবে এবার ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন থাকায় আগেভাগে বাজেট সংশোধন করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সার্বিক প্রেক্ষাপটে এবার ডিসেম্বর মাসে বাজেট সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া ভর্তুকির ৬২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বকেয়াও পরিশোধ করা হয়েছে। তবে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষককে এমপিওভুক্তি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা সুবিধা বাড়ানোর ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা সামাল দেওয়া কঠিন ।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, নতুন বেতন কাঠামোর জন্য বাড়তি ব্যয়ের মূল প্রভাব পড়বে আগামী সরকারের ওপর। বেতন কমিশন আগামী এপ্রিল বা মে থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিলে বর্তমান সরকারের কিছু ‘প্রভিশন’ রেখে যেতে হবে। সেই খরচ সামলানো যাবে কিনা, তা দেখার বিষয়। পেনশন পরিবর্তন নিয়েও নানা ধরনের দেনদরবার চলছে। তবে এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০১৫ সালের বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের পর থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন মূল্যস্ফীতির চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে– এমন দাবির পর্যালোচনা হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভাতা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের আর্থিক সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেতনের চেয়ে ভাতায় বরাদ্দ বেশি। সব কিছু হিসাবে নিলে আসলে কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি থেকে পিছিয়ে নেই।
তিনি বলেন, যেখানে দেশে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে, সেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটুকু সঠিক, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। একটা ঠুনকো যুক্তির ভিত্তিতে নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
গত জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতনের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধা দিয়েছে সরকার। বেতন গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৯ পর্যন্ত চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ওপর ১০ শতাংশ বাড়তি পাচ্ছেন। আর গ্রেড-১০ থেকে গ্রেড-২০ পর্যন্ত বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন ১৫ শতাংশ হারে। ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেয়ে আসছেন। বাড়তি মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় এ বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে সরকার।
গত ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ১৬ বছরে জনপ্রশাসন থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ পদোন্নতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত এই পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১১৯ জন সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্যান্য ক্যাডারের ৭৮ জন ‘বঞ্চিত’ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব পদোন্নতির জন্যও সরকারের বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে।
গত জুলাই মাসে পুলিশ সদস্যদের ঝুঁকি ভাতা ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত পুলিশ বিভাগের সদস্যদের চার ক্যাটেগরির পদের জন্য চাকরির বয়স অনুযায়ী পাঁচ ধাপে ভাতার হার নির্ধারণ করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের ঝুঁকি ভাতা বাড়ানোর ফলে এক অর্থবছরে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সারাদেশে এক হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।
বেড়েছে প্রশিক্ষণ ভাতা
গত ১৪ আগস্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিষয়ভিত্তিক অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ ভাতা বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী উভয়েরই ভাতা বেড়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আর প্রশিক্ষকদের ভাতা বেড়েছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। গত মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে যারা প্রশিক্ষণ নেবেন এমন সরকারি কর্মচারীদেরও প্রশিক্ষণ ভাতা ২০ থেকে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
বিদেশি মিশনে ভাতা বেড়েছে
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির প্রতিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৬০টি কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘বৈদেশিক’ ভাতা বাড়ানো হয় গত জানুয়ারিতে। স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সঙ্গে সমন্বয় করে ক্ষেত্রবিশেষ সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ ভাতা বাড়ার কারণে প্রতি অর্থবছরে সরকারের প্রায় ৩৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।