মানবজাতির ইতিহাসে বহু সংস্কারক, দার্শনিক ও নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রতিপক্ষকে দমন, শাস্তি বা ধ্বংস করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করেছেন। এর বিপরীতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে এসেছেন কেবল হেদায়াতের আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য, মানবতার কল্যাণে “রহমত” হয়ে। তাই তিনি কখনো নিজের শত্রুকেও কেবল শত্রু ভেবে অভিশাপ দেননি; বরং তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করেছেন।
এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আবূ হুরাইরাহ (রা.) বর্ণিত এ হাদিসে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ادْعُ عَلَى الْمُشْرِكِينَ قَالَ " إِنِّي لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً " .
আবূ হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহকে বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনি মুশরিকদের ওপর বদদোয়া করুন। তিনি বললেন, আমি তো অভিসম্পাতকারীরূপে প্রেরিত হইনি; বরং প্রেরিত হয়েছি রহমত স্বরূপ। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৯৯)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
১. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিশনের প্রকৃতি
এই হাদিস আমাদের জানায় যে, নবীজীর (ﷺ) মিশন কোনো জাতি বা সম্প্রদায়কে অভিশাপ দেওয়ার জন্য নয় ছিল না, বরং তাদেরকে হেদায়েতের আলোয় আনার জন্য ছিল।
কোরআনে আল্লাহ বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
‘আমি তো আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
অতএব এ কথঅ পরিষ্কার যে,, মহানবী (সা.)-্এর দাওয়াতের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে জান্নাতের পথে নিয়ে যাওয়া।
২. দাওয়াতের পদ্ধতি
মুশরিকরা কঠিনভাবে বিরোধিতা করত, কষ্ট দিত, অত্যাচার চালাত। তবুও মহানবী (সা.) কখনো প্রতিশোধের মানসিকতা পোষণ করেননি।
বদদোয়া না করে তিনি তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করেছেন। যেমন, ত্বায়েফবাসীরা নবী (সা.)-কে পাথর ছুঁড়ে রক্তাক্ত করেছিল, তখনও তিনি বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহ! এ জাতিকে হিদায়াত দিন, কারণ তারা জানে না।’ (সহীহ বুখারি, হাদিস: ৩২৩১)
৩. নবীজীর রহমতের প্রতিফলন
এই হাদিস মুসলমানদের শিক্ষা দেয় যে, দাওয়াতের কাজ প্রতিশোধ নয়, বরং মানুষের কল্যাণের জন্য। কাউকে গালমন্দ করা, অভিশাপ দেওয়া বা বদদোয়া করার বদলে নসীহত করা ও দোয়া করা শ্রেয়।
৪. অভিশাপ কখন বৈধ
তবে এর মানে এই নয় যে, কখনো অভিশাপ দেওয়া যাবে না।
কোরআন ও হাদিসে কোথাও কোথাও জালিম, কুফর, মুনাফিক বা দুষ্টচক্রের উপর বদদোয়া করা হয়েছে। কিন্তু তা ব্যক্তিগত প্রতিশোধের কারণে নয়, বরং আল্লাহর দীনকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী চরম শত্রুদের বিরুদ্ধে। মহানবী (সা.) সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ না করে তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করেছেন।
হাদিস থেকে শিক্ষা
ইসলামে দাওয়াতের মূলনীতি হলো রহমত ও কল্যাণ।
দাওয়াতদাতাকে সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল হতে হবে।
প্রতিপক্ষকে বদদো‘আ করার বদলে তার জন্য হিদায়াত কামনা করা উত্তম।
কেবল জালিমদের অন্যায় প্রতিহত করার জন্য বা আল্লাহর দুশমনদের জন্য অভিশাপ করা বৈধ।
সাধারণ মানুষের প্রতি করুণা ও মমত্ববোধই মুসলিম উম্মাহর পরিচয় হওয়া উচিত।