স্টাফ রিপোর্টার : যশোরের মনিরামপুর উপজেলার যশোর-রাজগঞ্জ সড়ক এলাকার দিঘিরপাড় বাজার। পাশেই জঙ্গলে ঘেরা একটি পরিত্যক্ত ভবন। ভাঙাচোরা ভবনের কক্ষগুলোর কোনো দরজা-জানালা টিকে নেই। ভেতরে কাদাপানি মাখা চেয়ার-টেবিল ঘুণ ধরে ভেঙে পড়েছে। মেঝেতে জমে থাকা পানিতে দেখা যাচ্ছে কীটপতঙ্গ। স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের এক প্রান্তে অস্পষ্টভাবে লেখা ‘ম্যানেজারের কক্ষ’। ঝোপঝাড়ের মাঝে জীর্ণদশায় উঁকি দেওয়া ভবনটি জানান দেয়, সেখানে মানুষের যাতায়াত নেই বহু দিন।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া ঠিকানামতে, এটি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নিবন্ধনযোগ্য বেসরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয়। সংস্থাটির নাম সার্ভিসেস ফর ইকুয়িটি অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (সীড)। রোববার কাগজপত্রে উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়।
গত শনিবার দেশের ৭৩টি বেসরকারি সংস্থাকে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নিবন্ধনযোগ্য বলে চিহ্নিত করে ইসি। এসব সংস্থার মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ ঢাকা জেলায় রয়েছে ২৭টি সংস্থার প্রধান কার্যালয়। এর মধ্যে গতকাল দৈবচয়ন ভিত্তিতে ১৩টিতে সরেজমিন গিয়ে তিনটি সংস্থার অস্তিত্ব পাননি প্রতিবেদকরা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের ৩৫টির কার্যালয়ের খোঁজ নিয়েছেন প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে কয়েকটি সংস্থার কার্যালয় কাগজপত্রে উল্লিখিত ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। একটির ঠিকানায় গিয়ে চা ও মুদি দোকান দেখা গেছে। তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি সংস্থা।
নাম-ঠিকানা ও অস্তিত্বহীন এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইসি। নিবন্ধনের শর্তে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অযোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ থাকলেও তা মানা হয়নি। এমনকি ইসির নিবন্ধনযোগ্য তালিকায় জায়গা পাওয়া একটি সংস্থার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন সাবেক এমপি।
গত ১৮ জুলাই কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের নিবন্ধিত ৯৬টি স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার সবকটির নিবন্ধন বাতিল করার কথা জানায় ইসি। এসব পর্যবেক্ষক সংস্থার বিরুদ্ধে বিতর্কিত প্রতিবেদন দাখিলসহ অবৈধ নানা সুবিধা লাভের অভিযোগ ছিল। তবে নতুনভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধনযোগ্য তালিকায় নাম আসা কয়েকটি সংস্থার বিরুদ্ধেও রয়েছে নানান অভিযোগ।
কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কারও দাবি বা আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে তা আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে ইসি বরাবর লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছে গণবিজ্ঞপ্তিতে। এরপর দাবি-আপত্তি নিয়ে শুনানি শেষে পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করবে ইসি। বর্তমানে দেশীয় কোনো সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে ইসিতে নিবন্ধিত হতে হয়।
ঢাকায় তিনটির অস্তিত্বই নেই
ইসির তালিকায় থাকা একটি প্রতিষ্ঠান ‘বাসাবো জনকল্যাণ সংস্থা (বিজেএস)’। এর ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে মিরপুরের দক্ষিণ পীরেরবাগ, পশ্চিম আগারগাঁও, ৬০ ফিট, ওসমান গনি রোড, ভাঙা ব্রিজসংলগ্ন, একুশে টাওয়ার। ঠিকানাটি আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে। গতকাল সেখানে গিয়ে এ নামে একটি নির্মাণাধীন ভবন পাওয়া যায়, যেখানে কোনো মানুষই বাস করে না। কোনো কার্যালয়ও নেই।
একুশে টাওয়ার নির্মাণ প্রকল্পের ম্যানেজার মো. হানিফ জানান, ভবনের কাজ চলছে। এখানে এখন কেউ থাকে না। তবে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের তালিকায় বিজেএস নামে একটি সংস্থার নাম থাকলেও তাদের কার্যালয় মাদারীপুরে। এ ছাড়া এ সংস্থার কোনো ওয়েবসাইট কিংবা সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট বা পেজ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইসির তালিকায় থাকা আরেকটি সংস্থা ‘বিয়ান মনি সোসাইটি (বিএমএস)’। মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের ১৬/১৬ ঠিকানায় এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি। ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘এই ঠিকানায় এই নামে অথবা অন্য কোনো উন্নয়ন সংস্থা বা কোনো অফিসের কার্যালয় নেই।’
একইভাবে উত্তর আদাবরের একটি অসম্পূর্ণ ঠিকানা ১(এ), (২য় তলা) অ্যাডাব (অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ) কার্যালয়ের কথা বলা হলেও তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকায় বাইতুল মুকাদ্দিম মসজিদের পাশে একটি তিনতলা সাদা ভবনের নিচতলায় ‘একটিভ এইড ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন’ সংস্থার অফিসের দেখা মেলে। ছোট একটি কক্ষের ভেতরে তিন-চারটি ডেস্ক, কয়েকটি কম্পিউটার, বেশ কয়েকটি চেয়ার ও সোফা দেখা যায়।
এ সংস্থার কোষাধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম জানান, তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অন্য একটি সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে তারা ঢাকার দুটি সংসদীয় এলাকায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন।
পুরানা পল্টনের বায়তুল খায়ের ভবনের চারতলার বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ইকোলজিক্যাল রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (বিএসইআরআই) কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যালয় মেসার্স মজুমদার ইন্টারন্যাশন্যালের এক পাশে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের একটি মাত্র কক্ষ। মাস ছয়েক আগে এটি ভাড়া নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও ডাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
মেসার্স মজুমদার ইন্টারন্যাশনালের মালিক ওমর ফারুক মজুমদার বলেন, ‘মাস ছয়েক আগে অফিসের একটি অংশ ভাড়া দিয়েছি। তিনি দিনের বেলা এখানে আসেন না। বিকেলে বা সন্ধ্যায় আসেন। মাঝেমধ্যে তাঁর কিছু শিক্ষার্থীও আসেন।’
জানতে চাইলে জসীম উদ্দিন জানান, এক বছর আগে এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন পেয়েছেন। ডাকসু নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। এখন লোকবল আর স্বেচ্ছাসেবী প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চান।
ইসির নিবন্ধনের শর্তে বলা আছে, নিবন্ধনযোগ্য হতে হলে কমপক্ষে দুই বছরের সম্পাদিত কাজের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এক বছর আগে যাত্রা শুরু করা এ প্রতিষ্ঠান কীভাবে যোগ্য হলো– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ৫-৬ বছর ধরেই তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ করছেন।
কাফরুলের সেনপাড়া পর্বতা অলাভজনক সেবামূলক সংস্থা পাথওয়ের কার্যালয়। তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের স্বাবলম্বী করতে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ুসহ নানা বিষয়ে কাজ করে সংস্থাটি। মোহাম্মদপুরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির ৮১৭ নম্বর চারতলা ভবনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমাহার–মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের কার্যালয়। এর আগে ২০০১, ২০০৮, সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর্যবেক্ষক তালিকায় নাম ছিল তাদের। তবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক তালিকায় নাম থাকলেও শেষ মুহূর্তে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেনি তারা।
ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের ২৭/১ নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডাক্তারবাড়ি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই ঠিকানায় গিয়ে ব্যানার ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। ভবনের ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শেখ লালন আহমেদের ‘লিগ্যাল কাউন্সিল’-এর একটি অফিস কক্ষ আরেকটিতে তাঁর পরিচালিত একটি কোচিং সেন্টার। এ বিষয়ে লালন আহমেদ বলেন, ভবনটির তৃতীয় তলায় পুরোটি ডাক্তারবাড়ি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের কার্যালয়। ‘ল’ ফার্ম আর কোচিং সেন্টারটি ডাক্তারবাড়ি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত।
মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের জার্মান ও জাপানের সাহায্যপুষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) কার্যালয়। খিলগাঁওয়ের ৪৪৩/বি শোভা মঞ্জিলে সোসাইটি ফর রাইট সোসাইটি ফর ব্রাইট সোস্যাল সার্ভিসেসের কার্যালয়।
এর আগে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেও রেজিস্ট্রেশন পায়নি সংস্থাটি। এবারই প্রথম প্রাথমিক তালিকায় সংস্থাটির নাম আছে।
সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘২০০৮ সালে খান ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আমরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজ করেছি। পরে তিনটি নির্বাচনে আবেদন করেও রেজিস্ট্রেশন পাইনি।’ বিজয়নগরের ইস্টার্ন আরজু ভবনে মুক্তি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়। এবারই প্রথমবারের মতো আবেদন করে পর্যবেক্ষকের প্রাথমিক তালিকায় নাম এসেছে প্রতিষ্ঠানটির। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন সাবেক এমপি তাসমিমা হোসেন।
সংস্থার চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন হীরা বলেন, ‘এ বছর অভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচনটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেছি।’
ইসিয়ার কার্যালয়ের কক্ষ মুদি ও চায়ের দোকান
বেসরকারি সংস্থা ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভ ফর সোসিও ইকোনমিক অ্যাকটিভিটি (ইসিয়া)। নিবন্ধনের জন্য জমা দেওয়া আবেদনপত্রে সংস্থাটির ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকার ধামরাই উপজেলার বাসনা গ্রাম। গতকাল সেখানে গিয়ে তার কোনো অফিস পাওয়া যায়নি। সেই আধাপাকা কক্ষগুলো এখন মুদি ও চায়ের দোকান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে বাসনা গ্রামের এমএ লতিফ বাসনা বাসস্ট্যান্ডে একটি আধাপাকা টিনশেড ঘরের ঠিকানায় নিবন্ধন নিয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইসিয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
আবাস-এর অফিসে পশু-পাখি, নেই কার্যক্রম
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নিবন্ধন পেয়েছে নাটোরের দুটি বেসরকারি সংস্থা আবাস ও সাথী। এর মধ্যে আবাসের কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলার বামাগাড়ী গ্রামে; সাথীর নাটোর পৌরসভার বড়গাছায়। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরে আবাসের নিবন্ধন থাকলেও সংস্থাটির সক্রিয় কার্যক্রম নেই। এ ছাড়া ইসির প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত নির্বাহী প্রধান আফজাল হোসেনের কোনো ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বামাগাড়ীর বাসিন্দারাও তাঁকে চেনেন না।
গতকাল সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফের বাড়ি কুমরুল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভাঙাচোরা কক্ষের সামনে ঝুলছে আবাসের সাইনবোর্ড। খোলা কক্ষে পশু-পাখি বাস করে।
‘সাথী’র প্রধান কার্যালয় নাটোর পৌরসভার বড়গাছা এলাকায় অবস্থিত। সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক শিবলী সাদিকের নিজ বাড়ির নিচতলায় এ অফিস পরিচালিত হচ্ছে।
যশোরের এক সংস্থার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
পর্যবেক্ষকের তালিকায় নাম থাকা যশোরের অপর প্রতিষ্ঠান দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে রয়েছে সরকারের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় পরিচালিত ‘সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রকল্প’তে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। সরকারের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থা কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বলে অভিযোগ তোলেন ভুক্তভোগীরা।
দিশার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানা বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী সংখ্যা ২৫। দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, দিশার যেসব প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো সঠিকভাবে শেষ হয়েছে। কাজের সনদও নেওয়া হয়েছে। আর দুদক এখনও মামলা করেনি।
ঝিনাইদহের তিনটি সংস্থাই নামসর্বস্ব
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নিবন্ধন পেয়েছে ঝিনাইদহের তিনটি নামসর্বস্ব সংস্থা। তবে কোনোটির কার্যক্রম সম্পর্কে তেমন জানা যায়নি। সংস্থাগুলো হলো– সদর উপজেলার বিষয়খালী এলাকায় অবস্থিত আলোকিত সমাজকল্যাণ সংস্থা, জেলা শহরের চাকলাপাড়া এলাকার অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসিও ইকোনমিক অ্যাডভান্সমেন্ট (এসিয়া) এবং একই এলাকার হেভেন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা।
এমএসকের মূল ফটকে তালা
জয়পুরহাট সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী কোমপুর বিজিপি ক্যাম্পের পাশে নওয়াপাড়া গ্রামে মানব সহায়ক কেন্দ্রের (এমএসকে) প্রধান কার্যালয়। ২০০২ সালে এই গ্রামে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম দিকে ৩-৪ বছর ভালোভাবে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা হলেও বর্তমানে তা বন্ধ। সংস্থার প্রধান কার্যালয় সাধারণ সম্পাদকের (নির্বাহী) গ্রামের বাড়িতে। স্থানীয়রা বলছেন, মাঝেমধ্যে একজনকে এ ঘর খুলতে দেখা যায়। প্রায় সময়ই তালা ঝোলে। কোনো কার্যক্রম নেই। এদের কাজ কী, তাও কেউ বলতে পারেননি।
হিলফুল ফুজুলের কাজ চলে অন্য ঠিকানায়
কাগজপত্রে হিলফুল ফুজুল সমাজকল্যাণ সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ভৈরবপাশা ইউনিয়নের ঢাপড় প্রতাপ গ্রাম। বাস্তবে সেখানে কোনো কার্যালয় নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড়ে প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেনের বাড়িতে সংগঠনটির কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে সেখানে সংস্থাটির কোনো সাইনবোর্ড নেই। সংগঠনটির মালিক হারুন অর রশীদ। তাঁর বাড়ি নলছিটি উপজেলার দুধারিয়া গ্রামে। তিনি পরিচালনা কমিটির সভাপতি। তবে বার্ধক্যের কারণে অসুস্থ তিনি। তাই সব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন আনোয়ারুল ইসলাম। সহসভাপতি ঝালকাঠি জেলা ইসলামী আন্দোলনের সদস্য মোক্তার আহমেদ।
র্যাক চালান বিএনপি-জামায়াত নেতার ভাই
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার নান্দিনা এলাকায় অবস্থিত রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি ফর বাংলাদেশ (র্যাক-বাংলাদেশ)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মো. ইবাদুর রহমান বাদল। তাঁর বড় ভাই আজিজুর রহমান বাচ্চু উপজেলার গাজীরচর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি এবং ছোট ভাই গাজীরচর ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি। তবে ইবাদুর রহমান বাদল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন। এনজিও হিসেবে ১৯৯৫ সালের ৯ মে নিবন্ধন পেয়েছে র্যাক।
অসেসের নির্বাহী পরিচালক সাবেক ছাত্রদল নেতা
নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে নতুন বাজার এলাকায় অগ্রগতি সেবা সংস্থার (অসেস) প্রধান কার্যালয়। সংস্থাটির চেয়ারম্যান রুহি দাস। তিনি বাস্তব নামে একটি এনজিওর চেয়ারম্যান। অসেস দেখাশোনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জামাল হোসেন। তিনি ১৯৯৯ সালে নারায়ণপুর রাবেয়া মহাবিদ্যালয়ের কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। তাঁর আপন মামা রফিকুল ইসলাম আলকাছ বর্তমানে নারায়ণপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি।
নরসিংদী সদর থেকে দুটি সংস্থা প্রাথমিক নিবন্ধন পেয়েছে। সংস্থা দুটি হলো– অর্গানাইজেশন ফর সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট (উষা) ও অন্তরঙ্গ সমাজকল্যাণ সংস্থা (এএসকেএস)। নরসিংদী সদরের ৫৬ কোর্ট রোডের ঠিকানায় গিয়ে উষার অস্তিত্ব মেলেনি। বিলাসদীর ১৫৩/১ কোর্ট রোডে কোথাও অন্তরঙ্গ সমাজকল্যাণ সংস্থার (এএসকেএস) নামে কোনো সাইনবোর্ড নেই।
মন্ত্রী-নেতার সঙ্গে সম্পর্ক এসডিআরএসের প্রধানের
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নিবন্ধন পেয়েছে গাইবান্ধার দুটি প্রতিষ্ঠান– গণউন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে) ও সমাজ উন্নয়ন পল্লী সংস্থা (এসডিআরএস)। জিইউকের কার্যালয় গাইবান্ধা সদরের নশরতপুরে। এটির নির্বাহী প্রধান এম আবদুস সালাম। এসডিআরএস সদর উপজেলার গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের কোমরপুরে অবস্থিত। এটি পরিচালনা করেন গোলাম মোস্তফা।
তিনি ২০০৩ সালে লিগ্যাল এইড ও হস্তশিল্প কর্মসূচি দিয়ে কাজ শুরু করেন। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে ২০ জন কর্মী রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোলাম মোস্তফা বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
চাঁদ মানব উন্নয়ন সংস্থায় কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের চাঁদট বাজারে একটি অফিস নিয়ে চাঁদ মানব উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম চলে। তাদেরই সাথি সংগঠন চাঁদ পাঠাগারের বিশাল সাইনবোর্ডের পাশে চাঁদ মানব উন্নয়ন সংস্থার তিন ফুট বাই দুই ফুটের একটি সাইনবোর্ডওয়ালা আধাপাকা অফিস আছে। বেতনভুক্ত কর্মচারী নেই। সংগঠনের ৩১ সদস্য আছে। তবে ৯ সদস্যের পরিচালনা পরিষদ পাঁচ-ছয় বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মানবিক উন্নয়নে কাজ করে আসছে। সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা প্রভাষক কামরুজ্জান।
খুলনার পাঁচটি সংস্থার তিনটিই অনভিজ্ঞ
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছে খুলনার পাঁচটি সংস্থা। এর মধ্যে তিনটির নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা নেই। প্রতিষ্ঠান তিনটির জনবলও অনেক কম। দুটি সংস্থা ইতোপূর্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। আবেদন করা পাঁচটি সংস্থারই খুলনায় নিজস্ব অফিস রয়েছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
খুলনা থেকে আবেদন করা সংস্থাগুলো হলো– রূপান্তর, আশ্রয় ফাউন্ডেশন, আরপিও ফাউন্ডেশন, রূপসা ও স্কোপ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে তাদের।
রাজশাহীর কর্ম উন্নয়ন কেন্দ্র তালাবদ্ধ
রাজশাহীর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্ম উন্নয়ন কেন্দ্র (ডব্লিউডিসি) পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে প্রাথমিক নিবন্ধন পেয়েছে। এ সংস্থার নির্বাহী প্রধানের নাম এবিএম রাসেল। ঠিকানায় দেওয়া আছে ২৮৯, তেরখাদিয়া, সেনানিবাস, রাজপাড়া, রাজশাহী। গতকাল দুপুরে সেই ঠিকানায় গিয়ে কার্যালয়টি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। দুইতলা ফ্লাটের চার ইউনিটবিশিষ্ট বাড়িতে এ কার্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলানো ছিল। কলিংবেল চাপলে মৌসুমি নাম এক ভাড়াটিয়া গৃহবধূ বেরিয়ে আসেন। তিনি বলেন, রাসেল চাচা এখানে থাকেন না। এটা তাঁর শ্বশুড়বাড়ি। তেরখাদিয়া মোড়ে তাঁর নিজ বাড়িতে তিনি থাকেন। এখানে তিনি কর্ম উন্নয়ন কেন্দ্রর অফিস খুলেছেন। এখানে কম্পিউটার শিখতে স্টুডেন্টরা আসেন।
এবিএম রাসেলের প্রতিবেশী সোহেল রানা বলেন, রাসেল ভাই ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করতেন। তিনি মহানগর জামায়াতের সাবেক আমির আতাউর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। তাঁর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের মিছিল-মিটিংয়ে দেখা যেত; ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
জানতে চাইলে এবিএম রাসেল বলেন, আমি কখনোই কোনো রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না। তবে আমার সেজ ভাই আমানউল্লাহ আদর আ.স.ম. আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ করতেন। ২০০৯ সালে তিনি মহানগর জাসদের সভাপতি ছিলেন। আমি কখনোই জামায়াত-শিবির করিনি।
অফিস বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে এবিএম রাসেল বলেন, আমার স্ত্রী অসুস্থ। তাকে ভারতের চেন্নাই নিয়ে চিকিৎসা শেষে ঢাকায় ফিরেছি। এখানেও কয়েকদিন চিকিৎসার জন্য থাকতে হবে। রাজশাহী ফিরতে আরও ৫-৭ দিন লাগবে।
তালা ঝোলে দীপ্ত মহিলা উন্নয়ন সংস্থায়
কুমিল্লা নগরীর রেসকোর্স এলাকার মফিজ উদ্দিন সড়কের একটি ভবনের নিচতলায় দুটি কক্ষে চলছে গ্রামীণ ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্টের (জিসা) কার্যক্রম। দুটি কক্ষের মধ্যে একটিতে বসেন নির্বাহী পরিচালক এবং অপরটিতে কর্মীরা। গতকাল দুপুরে গিয়ে নির্বাহী পরিচালক মো. আলমগীর হোসেনকে তাঁর কার্যালয়ে পাওয়া যায়। তখন পাশের কক্ষটি ছিল তালাবব্ধ। পরে তালা খুলে দিয়ে নির্বাহী পরিচালক জানালেন, কর্মীরা মাঠে আছেন।
আরও যা মিলল
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় সিন্দুরমতি এলাকায় ‘সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র কার্যালয় পাওয়া যায়নি। ভূরুঙ্গামারী উপজেলার জয়মনিরহাটে বেসরকারি সংস্থা বকুলতলা মহিলা সংসদের (বিএমএস) প্রধান কার্যালয়। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। কর্মকতা-কর্মচারী মিলে লোকবল ২২ জন। কাগজে উল্লেখ করা ঠিকানা থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে জয়মনিরহাট বাজারে ভাড়া বাসার কটি কক্ষে চলছে বিএমএসের কার্যক্রম।
রংপুর নগরীর কামালকাছনা এলাকার ৫ নম্বর এমসি সরকার রোডের ৫৪ নম্বর বাসার প্রধান ফটকে ঝুলছে পার্টিসিপেটরি অ্যাডভান্সমেন্ট সোশ্যাল সার্ভিসের (পাস) সাইনবোর্ড। চারতলা ভবনটির নিচতলায় প্রতিষ্ঠানের অফিস হলেও সেখানে গতকাল দুপুর পর্যন্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। তালা না থাকলেও অফিসের দরজা বন্ধ ছিল। আশপাশের বাসিন্দারা জানান, ওই ভবনটির মালিক খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট। তিনিই ওই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক।