বৃহস্পতিবার, 9 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

দুই দলকে সন্তুষ্ট রেখে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চেষ্টা

 

স্টাফ রিপোর্টার : বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্তুষ্ট রেখে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ বের করার চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিশেষজ্ঞ প্যানেল সনদ বাস্তবায়নে দুটি ‘প্যাকেজ প্রস্তারের’ পরামর্শ দিয়েছে। যাতে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে অভিমত গ্রহণ থাকবে।

ভোটের আগে সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নামা জামায়াতসহ সাত দলের চাওয়া অনুযায়ী, সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই সংবিধান সংস্কার কার্যকরের প্রস্তাবও থাকবে। এনসিপি, ছয় দলের গণতন্ত্র মঞ্চ এবং কয়েকটি বাম দলের প্রস্তাবিত গণপরিষদ বা সংবিধান সভাও রাখা হবে।


শুক্রবার রাতে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের ভার্চুয়াল সভায় এসব আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে সভা সূত্র। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধে আটকে থাকা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুটি ‘প্যাকেজ প্রস্তাবের’ পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল।

বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, প্রথম প্যাকেজে সংবিধান আদেশ, ১০৬ অনুচ্ছেদে মতামত গ্রহণ এবং গণভোটের পরামর্শ থাকবে। সংবিধান আদেশে গণভোটের বিধান রাখা হবে। আদেশ জারির পরে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের অভিমত গ্রহণে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স পাঠানো হবে। এই পরামর্শ বিএনপি ও জামায়াত– দুই দলের জন্য ‘উইন উইন সিচুয়েশন’। অর্থাৎ দুই দলের প্রস্তাবই থাকছে।

সভা সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় প্যাকেজে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভার প্রস্তাব করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ পরামর্শ অনুযায়ী, আগামী সংসদ নির্বাচনেই গঠিত

হবে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভা। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে। অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নেবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জুলাই সনদ গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঁচ বছর মেয়াদি সংসদে রূপান্তরিত হবে।

কমিশন সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতে সনদের যেসব বাস্তবায়ন পদ্ধতি এসেছে, সবগুলোই আলোচনা করা হয়েছে। এসব নিয়ে আগামী মাসের শুরুতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে ঠিক হবে, কোন কোন পদ্ধতি সরকারকে সুপারিশ করা হবে।

অনলাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশ নেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক। কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও যুক্ত ছিলেন।

দলগুলোকে অনমনীয় 
আগামী ৫ অক্টোবর কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার সংলাপে বসতে পারে বলে জানা গেছে। এর আগে কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরামর্শ দিয়েছিল, সনদে যেসব সংবিধান সংস্কারের সিদ্ধান্ত রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ ধারা অনুযায়ী সংবিধান আদেশ জারি হবে। তার মধ্যে– ১. আদেশে জুলাই সনদে উল্লখিত মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। ২. সংবিধান আদেশে গণভোটের বিধান রাখা যেতে পারে। সংবিধান আদেশ নিয়ে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হবে এবং ৩. যদি গণভোটের মাধ্যমে জনগণ সংবিধান আদেশের প্রতি সম্মতি দেয়, তবে তা কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকেই অনুমোদিত বলে গণ্য হবে।

জুলাই ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি না থাকায় এর অধীনে কীভাবে সংবিধান আদেশ জারি করা হবে– এ প্রশ্ন তুলে সংবিধান আদেশের ঘোর বিপক্ষে বিএনপি। সংবিধান আদেশ জারির ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে কিনা– এ বিষয়ে আপিল বিভাগের মতামত গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। আগামী সংসদে সাংবিধানিক সংস্কার অনুমোদনের পর তা গণভোটে দেওয়ার পক্ষপাতী বিএনপি। ১২ দলীয় জোট, ১১ দল, এনডিএম, এলডিপি, লেবার পার্টিসহ কয়েকটি দল ও জোট এ অবস্থানকে সমর্থন করছে। সাংবিধানিক আদেশে ভোটের আগে সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার কার্যকর এবং গণভোটে তা অনুমোদনের প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতসহ সাত দল।

এনসিপি গণপরিষদে সংবিধান সংস্কার চায়। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি শরিক সংবিধান সভার মাধ্যমে সংস্কার চায়। গণভোট কখন হবে– এ প্রশ্নে দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট নয়। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক সংলাপ সম্পন্ন হলেও বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক চলছে। তবে দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড়।

দলগুলোকে সন্তুষ্টে পরামর্শে বদল 
আলোচনা চালিয়ে যাওয়া একজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর অনমনীয় মনোভাবের কারণেই বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে সরকারকে একাধিক ‘প্যাকেজ প্রস্তাব’ সুপারিশ করা হবে। ঐকমত্য না থাকায় এমন কয়েকটি বাস্তবায়ন পদ্ধতি খোঁজা হচ্ছে, যা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের কাছাকাছি। ‘কমন গ্রাউন্ড’ তৈরি করতে পারলে দলগুলো রাজি হবে বলে আশা করা যায়। সংবিধান আদেশ জারি, নাকি সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা হবে– এই সিদ্ধান্ত সরকার নেবে। কমিশন মতামত দেবে না। 
ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল গত আগস্টে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মতামত গ্রহণের পরামর্শ বাতিল করেছিল। তবে ১১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রস্তাব করার পর আবারও তা কমিশনের আলোচনায় আসে। ২০ সেপ্টেম্বরের পর শুক্রবার রাতের বৈঠকেও দীর্ঘ আলোচনা হয়।

একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতার জন্যই পরামর্শে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যদিও সংবিধান আদেশ ও গণভোট সনদ বাস্তবায়নের সহজতর পথ ছিল। ১০৬ অনুচ্ছেদে মতামত গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ এবং সময়সাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু বিএনপির মতো বড় দলের মতামত উপেক্ষা করা বাস্তবসম্মত নয়। রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকলে পুরো সংস্কারই ভেস্তে যেতে পারে। আবার জামায়াতের মতো আরেকটি বড় দল সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট চাইছে। তাই ১০৬ অনুচ্ছেদ ও সংবিধান আদেশ– দুটোই রাখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দুই দলের মতামতই গৃহীত হবে।

তিনি আরও জানান, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে প্রথম প্যাকেজে থাকবে সংবিধান আদেশ, সুপ্রিম কোর্টের অভিমত গ্রহণ এবং গণভোট। বিকল্প হিসেবে সংবিধান সংস্কার সভা বা গণপরিষদ। নির্বাচিত এমপিরা শুরুতে সংবিধান সংস্কার সভার মাধ্যমে সাংবিধানিক বিষয়গুলোর সমাধান করবেন। তারপর এই সভা সংবিধানে রূপান্তর হবে। এ দুই প্যাকেজে প্রায় সব দলের মতামতেরই প্রতিফলন ঘটবে।

এনসিপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ সংস্কারকে টেকসই করতে যেসব যুক্তি দিচ্ছে, তা আমলে নিয়ে আগামী সংসদকে সংস্কার কার্যকরের আগপর্যন্ত গণপরিষদ বা সংবিধান সভা হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব করা হবে। বিশেষজ্ঞরাও পরামর্শ দিয়েছেন, গণপরিষদে গৃহীত সংস্কার ভবিষ্যতে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হবে। কারণ, গণপরিষদ বা সংবিধান সভার ‘কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার’ রয়েছে, যা সংসদের নেই।  

যদিও সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে এসব পরামর্শ অনড় অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কমিশনেরও। একজন সদস্য বলেন, তাহলে আর কিছুই করার থাকবে না। শুধু নির্বাচনের অশ্চিয়তা নয়, নৈরাজ্য তৈরি হবে। এই বার্তা দলগুলোকে দেওয়া হবে।  

বৈঠক সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ প্যানেল আগে যেসব পরামর্শ দিয়েছিল, সেগুলোর অসংগতি সংশোধনে আলোচনা হয়। ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হয়েছে, ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে সরকারের কাছে একাধিক সুপারিশ উপস্থাপন করা হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবিত গণপরিষদ গঠন, সংবিধান আদেশ জারি, ১০৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত গ্রহণের সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা হয়।

 

সর্বাধিক পঠিত