স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিল জলাধারে নির্মাণকাজ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন সমাজের বিশিষ্টজনরা। আজ শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সম্পাদক, সর্বজনকথা; অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক ড. শায়ের গফুর, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ফিরোজ আহমেদ, সদস্য, সংবিধান সংস্কার কমিশন, প্রাণ প্রকৃতি বিষয়ক লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কবৃন্দ আমিরুল রাজিব ও নাঈম উল হাসান, স্থানীয় জনগণ, বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সদস্য ও সহযোগী পরিবেশ সংগঠনসমূহ।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর পরিবেশ সচেতন নাগরিক ও বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ প্ল্যাটফরম ‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের’ সমন্বয়কবৃন্দসহ ৯ বিশিষ্ট নাগরিক পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলে চলমান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ বন্ধে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।
উক্ত পিটিশনের প্রেক্ষিতে আদালত পিটিশনকারীদের পক্ষে রুল দিয়ে ‘পান্থকুঞ্জ পার্ক’ ও হাতিরঝিল জলাধারের উন্মুক্ত স্থানে যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে তিন মাসের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেন।
বক্তারা বলেন, পান্থকুঞ্জ পার্ক এবং হাতিরঝিল জলাধারে নির্মাণকাজ পরিচালনা করার জন্য কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। পুরো প্রকল্পের যে পরিবেশ ছাড়পত্র সেটারও মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। এতদিন ধরে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগের কারণে হাতিরঝিল জলাধার ও পান্থকুঞ্জ পার্কের পরিবেশ ইতিমধ্যেই ধ্বংসের পাশাপাশি কাঁঠালবাগান-কাঁটাবন-নীলক্ষেতসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিবহন ব্যবস্থা সীমাহীন সংকটে পড়বে। ফলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে মর্মে সম্মেলন থেকে দাবি জানানো হয়।
রাষ্ট্রীয় আইন কানুন, নীতিমালা থেকে শুরু করে আদালতের নির্দেশনা পর্যন্ত অমান্য করে কিভাবে হাতিরঝিল জলাধার আর পান্থকুঞ্জ ধ্বংস করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পাঁয়তারা চলছে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন বক্তারা।
কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা ও পান্থকুঞ্জ প্রভাতী সংঘের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুদ্দিন তুহিন বলেন, ‘এ প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকে এলাকায় জলাবদ্ধতা বেড়ে গেছে।
একই সঙ্গে এলাকার মানুষের একমাত্র খোলা জায়গা পান্থকুঞ্জ পার্ক বন্ধ রেখে এলাকার বয়স্ক মানুষদের যেমন হাঁটার জায়গা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে, তেমনি বাচ্চাদেরও একমাত্র খেলার জায়গা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিগত সরকারের নানা স্বেচ্ছাচারির কারণে গণ-অভ্যুত্থান হয় এবং জনগণের আশা ছিল রাষ্ট্রীয় আইন-আদালতসহ সব প্রতিষ্ঠান মুক্তভাবে কাজ করতে পারবেন। একই সঙ্গে এ সরকার শুরুতে এসে বিগত সরকারের প্রকল্পসমূহ পুনর্মূল্যায়নের কথা বললেও সেটা করা হয়নি। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করা অন্তর্বর্তী সরকারও বিগত সরকারের পথেই হাঁটছে। বর্তমান উপদেষ্টারাও আগের সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের সুরে কথা বলা শুরু করেছেন এবং গত সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের পক্ষে যুক্তি দেওয়া শুরু করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তার প্রায় চার দশকের বসবাস। এ এলাকায় উন্নয়নের নামে যে ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তিনি তার প্রত্যক্ষদর্শী। মেট্রো স্টেশন থেকে শুরু করে নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সংবেদনশীল জায়গায় একের পর এক প্রকল্প তৈরি করে যেভাবে এর টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে তা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ইডেন কলেজসহ পলাশী এলাকার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা সমুন্নত রাখার জন্য প্রকল্পের এই অংশটি বাতিল করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. শায়ের গফুর বলেন, ‘এ প্রকল্পের সঙ্গে বিদেশি সংস্থা জড়িত থাকলেও আমাদের দেশে তাদের এসব অপকর্ম করে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এ দেশেরই কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘নকশা বহির্ভূতভাবে নেওয়া এ র্যাম্প শুধু কম্পানির মুনাফার জন্য যুক্ত করা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো একটি স্থাপনা যা শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি মালিকদের কাজে আসবে, তা এ ধরনের জনবহুল এলাকায় প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে নেওয়া একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং তা অত্র এলাকার বাসযোগ্যতা আরো কমিয়ে আনবে।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরেও এখনো যে হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জে কাজ চলমান রয়েছে সেটার তীব্র প্রতিবাদ জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূমিকম্প ও অগ্নি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে আলোচনা হয় সেখানে কাঁঠালবাগান, কলাবাগান এলাকার মানুষজনের একমাত্র উন্মুক্ত স্থানকে ধ্বংস করে তাদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’
প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ক লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য পান্থকুঞ্জের ৪৫ প্রজাতির প্রায় ২০০০ পূর্ণবয়স্ক গাছ ধ্বংস হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকার কিংবা বাসস্থানের অধিকার কেবল মানুষের নয়, পশুপাখিসহ প্রতিটি প্রাণপ্রজাতির একই অধিকার রয়েছে। পান্থকুঞ্জের গাছগুলোতে বহু পাখি, পতঙ্গ, বাদুড়ের বাসস্থান ছিল। পান্থকুঞ্জের গাছ কাটার মাধ্যমে প্রাণী কল্যাণ আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।’