স্টাফ রিপোর্টার : কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে ভ্রাম্যমাণ আদলতের নামে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগের মামলায় কারাগারে থাকা কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে এ আবেদন করেন রিগানের আইনজীবী ইশরাত হাসান।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) মামলার আইনজীবীরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ওই মামলায় কারাগারে থাকা সুলতানা পারভীনকে গত ৯ সেপ্টেম্বর ছয় মাসের জামিন দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে করা সুলতানা পারভীনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ সুমনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে আসামির আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফয়জুল্লাহ ফয়েজ প্রমুখ। অন্যদিকে আরিফুল ইসলাম রিগানের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবি।
পরে সে জামিনাদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেন রিগানের আইনজীবী ইশরাত হাসান।
গত ২ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সুলতানা পারভীনের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। কুড়িগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মোসাম্মৎ ইসমত আরা এই আদেশ দেন। রিগানের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু এ তথ্য জানান।
আদালত সূত্র জানায়, ২ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া ১১টার দিকে আদালতের এজলাস কক্ষে প্রবেশ করেন সুলতানা পারভীন। প্রথমে আদালতের কাঠগড়ায় না উঠে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। রিগারের আইনজীবী বিষয়টি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে আসামিকে কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। আসামি পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ফখরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী। রিগানের পক্ষে আজিজুর রহমান দুলুসহ জেলা বারের বেশ কয়েকজন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন।
আদালত প্রথম দফায় প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনেন। পরে মুলতবি দিয়ে আবার দুপুর আড়াইটায় শুনানি শুরু হয়। উভয় পক্ষের শুনানি ও এজাহার পর্যালোচনা করে আদালত সুলতানা পারভীনের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদেশের কিছু পরেই প্রিজন ভ্যানে সুলতানা পারভীনকে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট সুলতানা পারভীন হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করেন। হাইকোর্ট তাকে জামিন না দিয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলা জজ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এরপর সুলতানা পারভীন ২১ আগস্ট কুড়িগ্রাম জেলা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন। তবে আইন অনুযায়ী তিনি সশরীরে আদালতে উপস্থিত হননি। এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে রিগানের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেন। ২ সেপ্টেম্বর আদালত সবকটি আবেদন শুনানি শেষে আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কার করে ডিসির নামে নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে আরিফুল ইসলাম রিগানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসনের তিন ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার উদ্দেশে জেলা শহরের পূর্বে ধরলা নদীর তীরে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে নেওয়া হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। সেখানে বিবস্ত্র করে পেটানো হয় তাকে। এরপর মাদক রাখার অভিযোগ দেখিয়ে মধ্যরাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। এ নিয়ে সারা দেশে প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ শুরু হলে একদিন পর সাংবাদিক রিগানকে জামিন দেয় জেলা প্রশাসন।
জামিনে মুক্তি পেয়ে কুড়িগ্রাম সদর থানায় তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন ও তিন ম্যাজিস্ট্রেটসহ অজ্ঞাত ৩০ থেকে ৩৫ জনকে আসামি করে এজাহার দায়ের করেন রিগান। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ এজাহারটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করে কুড়িগ্রাম সদর থানা-পুলিশ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটি তদন্ত করে ঘটনার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। চার্জশিটে সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন, তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা এবং এস এম রাহাতুল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর জামিন নিতে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন সুলতানা পারভীন। অপর আসামিরা এখনও আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি।
পরে সাংবাদিক আরিফ বলেন, ‘সংবাদ প্রকাশের জেরে আমাকে বিনা অপরাধে মধ্যরাতে স্ত্রী-সন্তানদের সামন থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে পাঠায়। ন্যায় বিচার পাওয়ার আশায় দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে প্রতীক্ষা করছি। আজ প্রাথমিকভাবে আদালতের কাছে ন্যায় বিচার পেয়েছি। প্রমাণ হয়েছে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। আমি মনে করি, এটি দেশের সাংবাদিক সমাজ, আমার সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য স্বস্তির খবর। শেষ পর্যন্ত ন্যায় বিচার পাবো বলে বিশ্বাস করি। আর কেউ যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাংবাদিকসহ দেশের কোনও নাগরিকের ওপর বেআইনি পদক্ষেপ নিতে না পারে।’