বুধবার, 17 সেপ্টেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

স্কুলের ভেতরে আ.লীগ নেতার তিনতলা বাড়ি, ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা


পাবনা সংবাদদাতা : পাবনার চরতারাপুর ইউনিয়নের নতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে জোরপূর্বক আওয়ামী লীগ নেতার তিনতলা ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। ভবনটি স্কুলের মাঝখানে হওয়াতে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। দ্রুত বিল্ডিংটি উচ্ছেদ করে স্কুলের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।


‎অভিযুক্ত আব্দুল বাতেন চরতারাপুরের নতুন বাজার এলাকার আব্দুল মাজেদের ছেলে। তিনি ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা। এর আগে তিনি ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে চরতারাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর আপন চাচাতো ভাই।

‎মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সরেজমিন স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শহীদ মিনার ঘেঁষে স্কুলের ঠিক মাঝখানে তিনতলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিং বাড়ি। বিল্ডিং বাড়ির পূর্বে স্কুলের একটি টিনের ঘর, পশ্চিমে আরেকটি টিনের ঘরে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হচ্ছে। বাড়িতে প্রবেশের পথও স্কুলের ভেতর দিয়ে করা হয়েছে। এজন্য স্কুলের গেটও করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।


‎খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনা সদরের চরতারাপুর ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত নতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয় ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুনামের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছেন শিক্ষকরা। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত রয়েছে। ২০১০ সালের দিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ-যুবলীগের অফিস করার কথা বলে স্কুলের ভেতরে একটি টিনের ঘর তোলেন আব্দুল বাতেন নামের ওই আওয়ামী লীগ নেতা। এরপর ইট-বালু এনে বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করেন। এসময় স্থানীয়রা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেন। শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ নিয়ে গেলেও স্থানীয় এমপি গোলাম ফারুক প্রিন্স ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোশাররফ হোসেনের জন্য অভিযোগ আমলে নিতে পারেনি কর্মকর্তারা। এরপর যারাই প্রতিবাদ করেছে নানা ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত ও হত্যার হুমকিও দেওয়া হতো।

‎এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, বিল্ডিং নির্মাণ করার সময় আমরা বাঁধা দিলে রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে আসত। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি এসব করে গেছেন। এছাড়া তিনি এ অঞ্চলে নানা অপকর্ম করে গেছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এটার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনেক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে। দ্রুত অপসারণ করে সেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

‎বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজিম হোসেন, বিথি আক্তার, লামিয়া খাতুন বলেন, স্কুলের একদম মাঝখানে বাড়িটি করা হয়েছে। ঠিক স্কুলের শহীদ মিনার ঘেঁষে বিল্ডিংয়ের বিস্তৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া যায় না। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনের জায়গা হয়। প্রতিদিন সকালে এসেম্বলীতে সমস্যা হয়, দিবসগুলোর অনুষ্ঠান করতে পারি না। মাঝেমধ্যে ময়লা আবর্জনা ওপর থেকে ফেলানো হয়। তখন দুর্গন্ধে স্কুলের মাঠে থাকা যায় না। যখন বাথরুমের ট্যাংকের মুখ খোলা হয় তখন আমরা ক্লাস করতে পারি না। ক্লাস থেকে বের হয়ে স্কুল আঙিনার বাইরে যেতে হয়। দ্রুত বিল্ডিং অপসারণ করা হোক।

‎স্কুলের সহকারী শিক্ষক ইকবাল হোসাইন অভিযোগ করে বলেন, বাড়িটির জন্য আমরা চরমভাবে বিব্রত হচ্ছি। লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্ন হচ্ছে। বাড়িটির জন্য স্কুলের গেট বানানো যাচ্ছে না। সেজন্য নিরাপত্তাও নেই। ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন জায়গা হয় না। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান করতে গেলে জায়গা সংকুলান হয় না। এজন্য বাড়িটি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বেড়ে গেছে। জায়গা হচ্ছে না। গাদাগাদি করে পাঠদান করানো লাগছে। বিল্ডিংটি অপসারণ করা হলে ওখানে স্কুলের জন্য ঘর করা হলে তাও আপাতত শিক্ষার্থীদের একটু হলেও দূর্ভোগ কমে আসবে।

‎বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পৃথিবীর কোথাও কোনদিন কেউ শুনেছেন যে স্কুলের ভেতরে বাড়ি করে? কিন্তু আমাদের এখানে স্কুলের ঠিক মাঝখানে জোরপূর্বক ক্ষমতার জোরে বিল্ডিং নির্মাণ করেছে আওয়ামী লীগ নেতা। শিক্ষার্থীদের খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত এটি অপসারণ করে পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি বাড়ির মালিককে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

‎তিনি আরও বলেন, ২০০২ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে ৯ জন মিলে এই স্কুলের জমি দান করেন। এরপর ২০১৩ সালের দিকে সে এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর ২০২২ সালের জমিদাতাদের থেকে জোরপূর্বক ভুয়া দলিল করে হয়রানি করছে। হয়রানি ও বিল্ডিং বাঁচানোর জন্য সে বহু কায়দা অবলম্বন করেছে। আমরা দ্রুত বিল্ডিং অপসারণ চাই।

‎ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমি ২০১৬ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এখানে যোগদান করি। আমি আসার আগেই ২০১৩ সালের দিকে সাবেক প্রধান শিক্ষক শামসুর রহমান ও সাবেক সভাপতি শামসুল আলমের আমলে জোরপূর্বকভাবে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। বাড়িটি নির্মাণের পর থেকেই ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, শিক্ষা অফিস সহ পাঁচটি অফিসে জমির কাগজসহ অভিযোগপত্র জমা দেই, কিন্তু কোথায় থেকে কোনো ফিডব্যাক পাচ্ছি না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উভয়ই কষ্টের মধ্যে আছি।

‎তিনি আরও বলেন, গত কয়েকদিন আগেও কয়েকটি অফিসে ধরনা দিয়ে আসছি বাড়িটি উচ্ছ্বেদের জন্য। বাড়িটি একদম স্কুলের ভেতরে হওয়াতে ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে। দিন দিন ছেলেমেয়ে বাড়লেও একটি ঘরও করতে পারছি না। দ্রুত বাড়িটি করে স্কুলের প্রকৃত পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

‎এ বিষয়ে অভিযুক্ত আব্দুল বাতেন বলেন, বিদ্যালয়ের জমিদাতার থেকে ২০২২ সালে আমি ৪ শতাংশের একটু কম জমি কিনেছিলাম। এজন্য বাড়ি করেছি। আওয়ামী লীগের সময়ে বহুবার ভবনটি ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু ভাঙতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০১০ সালের দিকে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়।

‎পাবনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কোনো ব্যক্তিগত বাড়ি হতেই পারে না। সেখানে লেখাপড়া করবে ছেলেমেয়েরা। সেখানে কারও থাকার জায়গা হবে কেন? বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শিক্ষা ও আইসিটিতে বিষয়টি তদন্ত করতে বলেছি। এরপর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
 

 

সর্বাধিক পঠিত