স্টাফ রিপোর্টার : দীর্ঘ সময় কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে ক্রমে অবনতির দিকে গেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সূচক। তবে গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সূচকগুলোর ইতিবাচক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এ অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারায় উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে অভ্যন্তরীণ বাধা।
এ অবস্থায় আজ সোমবার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। জাতিসংঘ ২০০৭ সাল থেকে সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে গণতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি এবং গণতন্ত্র চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য এ দিনটিকে প্রচলিত একটি বিশেষ দিন হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। এবারের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘অ্যাচিভিং জেন্ডার ইকুইলিটি অ্যাকশন বাই অ্যাকশন’ (পদক্ষেপের পর পদক্ষেপ গ্রহণ করে লিঙ্গ সমতা অর্জন)।
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গতকাল রোববার এক বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আমাদের একযোগে কাজ করে যেতে হবে। রাষ্ট্র মেরামতের ভিত্তি হবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের সকল মূলনীতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োগ।
উন্নয়ন অংশীদার ও বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার হোঁচট খেয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে অনেক কিছু নির্ভর করবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে সংস্কারগুলো সম্পাদন করবে। যাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা। শেখ হাসিনার অধীনে দেড় দশক ধরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়নের পর হঠাৎ করেই দেশে রাজনৈতিক সংস্কার একটি কঠিন কাজ হবে।
বিগত সরকারের পতনের ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, শ্রমিক ইউনিয়ন, বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অনুষদ সদস্যদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্রীয় চাপ হ্রাস পেয়েছে। যার কারণে দেশের গণতান্ত্রিক সূচকে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তবে এখনও অনেক কিছু অমীমাংসিত।
কূটনীতিকদের মতে, নতুন সরকারের এজেন্ডাগুলোতে উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আইনি সংস্কার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে সংবিধান সংশোধন বা পুনর্গঠন, গত বছরের সহিংসতার পাশাপাশি অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। পাশাপাশি নির্বাচন অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উত্তেজনা হ্রাস, অর্থনীতি স্থিতিশীলতা এবং শেখ হাসিনার বিষয়ে কী করা উচিত– সে বিষয়ে নানামুখী চাপ রয়েছে সরকারের ওপর।
পশ্চিমা দেশের এক রাষ্ট্রদূত নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বাংলাদেশ এখন অনেক অনিশ্চয়তা নিয়ে চলছে। আর এসব অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। দলগুলো ক্ষমতায় নিজ আধিপত্য বজায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ফলে উন্নত গণতন্ত্রের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কারগুলোতে একমত হতে পারছে না। এতে আগামীর বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
এ নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোসহ জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমালোচনা নেওয়ার সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব এবং জনগণ যে ক্ষমতার উৎস– সেটি বিশ্বাস ও চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। মূল্যবোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো চর্চার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। একেক দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো একেক রকম। যে কাঠামোই প্রতিষ্ঠা করা হোক না কেন, তা যাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাকে সহযোগিতা করে। যাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরিতে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা রয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই এ কাঠামোকে কার্যকর করা যায়নি। নামে বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকলেও একক দল ও একক ব্যক্তির আওতায় দেশ চলে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদা করে রাখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা নিশ্চিত করা এবং জনস্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয়।