সোমবার, 15 সেপ্টেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সমঝোতায় গুরুত্ব সরকারের

স্টাফ রিপোর্টার : সংবিধান সংস্কারে সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোট নয়, রাজনৈতিক সমঝোতাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সময় দিতে চায় সরকার। এর আগে সনদ বাস্তবায়নের কোনো পদ্ধতি চাপিয়ে দিতে চায় না।  

গতকাল রোববার ৩০ রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন বার্তা দিয়েছেন। তিনি কমিশনের সভাপতি।


গতকাল রোববারের সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমঝোতার জন্য আলোচনা অব্যাহত রাখতে কমিশনের মেয়াদ আবারও বাড়ানো হচ্ছে।  

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে তৃতীয় ধাপের সংলাপে জুলাই সনদের বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যে সমঝোতার রাস্তা শুরু করেছি, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সমঝোতায় আসতেই হবে। জাতি হিসেবে আমাদের নবযাত্রার সুযোগ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দিয়ে গেল, সেটার একমাত্র সমাধান হলো সমঝোতার পথে গিয়ে নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা।’

দলগুলো ছাড় দিচ্ছে কম, সরকারের অপেক্ষা

সংলাপ সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, সনদ বাস্তবায়নের কোনো পদ্ধতি সরকার চাপিয়ে দিতে গেলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। আবার সনদ বাস্তবায়ন না হলে, নির্বাচন আয়োজনে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। তাই শেষ সময় পর্যন্ত সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাবে সরকার।

গতকালের সংলাপে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংসদ নির্বাচনের তপশিল হতে পারে। তাই ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সংস্কার শেষ করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য দুই দিন সময় দেওয়া হয়েছে। আগামী বুধবার আবার দলগুলো নিয়ে সংলাপে বসবে কমিশন।

গতকালের সংলাপে সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ প্রায় সব দল নিজস্ব অবস্থান থেকে সামান্য ছাড় দিয়েছে। নির্বাচিত সংসদে সংবিধান সংস্কারে অনড় থাকা বিএনপি গতকাল এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিতে পারেন।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদের ৮৪টি সংস্কার নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করতে ‘প্রভেনশিয়াল সংবিধানিক আদেশ’ জারি করে তা গণভোটে দিতে হবে।

জামায়াতের মতো এনসিপিও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চেয়েছে। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সনদের অধীনে গণপরিষদ নির্বাচন করে সংবিধান সংস্কার কার্যক্রমকে টেকসই করতে হবে।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানসহ আরও কয়েকটি দলের প্রতিনিধি সনদের আইন ভিত্তি এবং বাস্তবায়নের উপায় খুঁজতে ঐকমত্যের কথা বলেন।

সভাপতির বক্তব্যে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা নানান যুক্তি দিতে পারি। কিন্তু সমাধানের পথে থাকতে হবে। অনেকের হয়তো কষ্ট হবে, কিন্তু পরে শান্তি পাবেন।’

বিশেষজ্ঞদের মত সাংবিধানিক আদেশ, সরকারের গুরুত্ব সমঝোতায়

জুলাই সনদ চূড়ান্ত করে গত বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন। এতে ৮৪টি সংস্কারের সিদ্ধান্ত রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামতে। ৭৩টিতে ঐকমত্য হলেও ১১টিতে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে। বিএনপির আপত্তি রয়েছে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, কমিটির মাধ্যমে দুদকে নিয়োগসহ কয়েকটি সিদ্ধান্তে। ক্ষমতায় গেলে দলটির এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজি নয়।

তবে বিএনপি সনদে সই করতে রাজি। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্তত আটটি দল সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ ছাড়া সনদ সইয়ে রাজি নয়। সনদের অঙ্গীকারনামায় সনদকে সংবিধানের অংশ করার অঙ্গীকার রয়েছে। এতে আপত্তি রয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের। তবে দলটি যেসব সংস্কার অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব সেগুলো নির্বাচনের আগে কার্যকরে রাজি।

বাস্তবায়ন পদ্ধতির পথ খুঁজতে গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আগে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বসে কমিশন। এর তিন দফায় বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, গণভোট, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশে সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

তৃতীয় বৈঠকে তারা সংবিধান সংস্কারে ‘সাংবিধানিক সংস্কার আদেশ’ এবং গণভোটের পরামর্শ দেন। গত বৃহস্পতিবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কমিশনের বৈঠকে সাংবিধানিক আদেশে সংস্কারের পরামর্শ দেন।

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গতকালের বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা ‘সংবিধান আদেশ-২০২৫’ জারির মাধ্যমে নির্বাচনের আগে সংবিধান সংস্কারের পরামর্শ দেন। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টাকে এই পরামর্শ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। তবে তিনি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

সবকিছু নির্ভর করছে শেষ অংশটুকুর ওপর

জুলাই সনদ প্রণয়নকে মূল কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে ঐকমত্য না হওয়াকে তিনি সামান্য পথ বলেছেন। তবে শেষ পথের ওপর পুরো বিষয় নির্ভর করছে মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনারা মূল কাজটা করে ফেলেছেন, সামান্য রাস্তা বাকি। সবকিছু নির্ভর করছে শেষ অংশটুকুর ওপর। আপনারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। বাকি রাস্তাটুকু সুন্দরভাবে সমাপ্ত করে পৃথিবীর জন্য নজির সৃষ্টি করে যাবেন।’

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মহোৎসবের নির্বাচন হবে। জাতির সত্যিকার নবজন্ম হবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে আলাদিনের চেরাগের সঙ্গে তুলনা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা তার কাছে কী চাইব? আমরা কি তার কাছে এক কাপ চা চাইব? না দুনিয়া পাল্টে ফেলতে চাইব? এ সুযোগটা এসেছে। সেখানে ছোটখাটো বিষয়ের মধ্যে আটকে গিয়ে আমরা যেন মূল, বড় বিষয় হারিয়ে না ফেলি।’

সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘স্বৈরাচার আসার সব পথঘাট বন্ধ করতে হলে সবাইকে একমত হয়ে করতে হবে। দ্বিমত করলে কাজ সমাপ্ত করতে পারব না। সবাইকে একমত হয়ে সনদ করতে হবে। তাহলে নির্বাচন সার্থক হবে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধেই হবে। আমরা হাইওয়ে বানিয়ে ফেলেছি। এ পথেই যাব। আমাদের আবেদন, সব পথঘাট বন্ধ করতে হবে, যাতে কোনো জায়গা দিয়ে ঢুকতে (স্বৈরাচার) না পারে। কাজটা করে ফেলতে পারলে আমাদের দেশ নিশ্চিন্ত হবে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশ আমাদের থেকে শিখতে আসবে।’

ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম ভালোভাবে শেষ করার অনুরোধ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এ কাজ যেন নিখুঁত ও নির্দোষ হয়। এমনভাবে করব, যাতে তা থেকে নতুন জাতি জন্মগ্রহণ করবে।’

আদালতের মতামতের প্রস্তাব বিএনপির

সংলাপের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন অবশ্যই ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এর বিকল্প নেই। তিনি জানান, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের জন্য বিএনপি ইতোমধ্যে দুজন প্রতিনিধির নাম পাঠিয়েছে। সনদে কিছু সংশোধনী ও পর্যবেক্ষণ থাকলেও তা গুরুতর কিছু নয়।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পর যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য প্রধান উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিতে পারেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ছোট ছোট বৈঠকের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের পথ আরও সুসংহত করা যেতে পারে।

এর আগে সংলাপে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে তা শুধু জাতীয় নিরাপত্তাই নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ বিএনপি একমত হয়েছে। যারা নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পাবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট রক্ষা করে বাস্তবায়ন করবে। দু- তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া বাকিগুলো সাধারণ বিষয়। বাস্তবায়নও খুব সহজ।

সাংবিধানিক সংস্কার সংসদ ছাড়া অন্য ফোরামে হতে পারে কিনা– এ প্রশ্ন তুলে সালাহউদ্দিন বলেন, আইনি পরামর্শের জন্য আদালতের সহায়তা নিতে পারি। সংসদের বাইরে কোনো পথ থাকলে জানান।

আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদে সই নয়– কয়েকটি দলের এ অবসস্থানের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ আলোচনা হলে বিএনপি অংশ নেবে। অঙ্গীকারনামার বিষয়ে বিএনপি লিখিত মতামত দিয়েছে। আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তেমন কোনো দলিল হতে পারে না। সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাইরেও আইনি ভিত্তির পথ থাকতে পারে। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের পরামর্শ নিয়ে করা যায় কিনা– তা দেখা যায়। ফলে ভবিষ্যতে আদালতে প্রশ্ন তোলা হলে বলা যাবে, আপনারা পরামর্শ দিয়েছিলেন।

সনদের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় জামায়াত

জামায়াতের হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সনদ বাস্তবায়নের দুটি পথ, প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন অর্ডার এবং গণভোট। দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটে মানুষ রায় দেবে। সংস্কারের প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্কার।

জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) তৈরি হবে। নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে, সুষ্ঠু হবে, গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু ছাত্র সংসদের দুটি নির্বাচন আমাদের কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছে। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টাকে নেতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখতে চাই।’

সংবিধান সংস্কার টেকসই করতে গণপরিষদ

অতীতে পাঁচটি সংবিধান সংশোধনী আদালতে বাতিল হওয়ার উদাহরণ দিয়ে আখতার হোসেন বলেন, টেকসই সংস্কারের উপায় গণপরিষদ নির্বাচন। যেসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো গণপরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

আখতার হোসেন বলেন, সংবিধানের অনেকগুলো মৌলিক কাঠামো সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে। এগুলো করলে সংবিধানে বড় পরিবর্তন আসবে। এ পরিবর্তন শুধু সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে টেকসই করা সম্ভব কিনা– এ আশঙ্কা রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আদিলুর রহমান খান, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির, সৈয়দ রিজওয়ানা হাসানসহ কমিশনের সদস্যরা।

 

সর্বাধিক পঠিত