জাবি প্রতিনিধি : আট ঘণ্টায় ১২ হাজার ভোটারের ৬৭ শতাংশ ভোট দিয়েছেন, সেই ভোট গুনতে লেগেছে ৪৮ ঘণ্টা, আর সব মিলিয়ে ফল পেতে লাগল তিন দিন।
প্রায় ৩৩ বছর পরে আয়োজিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে এমন বিরল নজির দেখল মানুষ।
এ সময়ে ভোট গুনতে ডেকে আনা একজন শিক্ষক অসুসন্থ হয়ে মারা গেছেন। পদত্যাগ করেছেন নির্বাচন কমিশনের দুইজন সদস্য ও নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা তিনজন কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান থেকে থেকে ভোট গণনার যন্ত্র (ওএমআর মেশিন) কেনা, ক্লোজ সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেলা ও ব্যালট সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত নেয়।
এর পরেও ‘অনিয়ম’ ও ‘কারচুপির’ অভিযোগ তুলে একে একে পাঁচটি প্যানেল ভোট বর্জন করে। ভোটগ্রহণে তার পরেই শুরু হয় ভোট গণনার দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং বার বার ফল ঘোষণা পেছানোর পালা।
এর মধ্যে জাকসুর এই নির্বাচনে ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে যেমন প্রশ্ন ওঠেছে, তেমনি ‘গ্রহণযোগ্যতার’ আলোচনাও সামনে এসেছে।
যদিও শনিবার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ভোটের ফল ঘোষণা কার্যক্রম শুরু করতে এসে কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে ‘প্রতীয়মান’ হয়নি দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম।
অবশ্য ভোট পরিচালনা ও গণনার ক্ষেত্রে কিছু ‘বিচ্যুতি’ হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
এর আগে একইরকম বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, অনিয়ম প্রমাণ হলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
তবে রাজনীতি বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, “আমরা দেখেছি ভিডিওতে একজন শিক্ষক বলছেন যে, ভোট চুরি করলে তুমি কি করবা? এটার আসলে মানে দাঁড়ায়, ভোট প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেউ আসলে যখন এটা বলে, তখন শেষ পর্যন্ত এই ভোট কিন্তু ‘অগ্রহণযোগ্য’ হয়ে যায়।”
অপর দিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, “এসব নির্বাচনে এগুলো অভিযোগ একটু আসবে। কিন্তু আমার মনে হয় যে নির্বাচন ঠিকই আছে।”
শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলেছেন, একচেটিয়া শিবির জেতায় আশাহত হওয়ার মতো ব্যাপার রয়েছে। নির্বাচনে অব্যবস্থাপনাসহ নানা অনিয়মে তাদের হতাশার কথা বলেছেন।
জাকসু নির্বাচনে ফল ঘোষণার পর উল্লসিত ‘স্বতন্ত্র’ ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু, ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম, এজিএস প্রার্থী ফেরদৌস আল হাসান ও নারী এজিএস প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা।
জাকসু নির্বাচনে ফল ঘোষণার পর উল্লসিত ‘স্বতন্ত্র’ ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু, ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম, এজিএস প্রার্থী ফেরদৌস আল হাসান ও নারী এজিএস প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা।
ডাকসুর পর জাকসুতেও শিবিরের বিশাল জয়
ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণা কার্যক্রম শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে বিকাল সোয়া ৫টার দিকে। হল সংসদ দিয়ে শুরু করে কেন্দ্রীয় সংসদের ফল ঘোষণা শেষ করতে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৭টা হয়ে যায়।
পৌনে ৬টার দিকে আল বিরুনী হলের রিটার্নিং অফিসার হল সংসদের ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা কার্যক্রম। তার আগে চলে বক্তৃতা পর্বও।
বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণার মধ্যে বিপুল জয়ের উল্লাস ধ্বনি ওঠে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের সমর্থকদের কণ্ঠে।
১৯টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ১৫টি জিতেছে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। বাকি চারটি পদের মধ্যে ভিপিসহ তিনটি পদে স্বতন্ত্র এবং একটিতে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-বাগছাস প্রার্থী জয় পেয়েছেন। সবমিলিয়ে ২৫ পদের ২০টিতেই জয় পেয়েছে শিবিরের প্যানেল।
আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভৌগলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও শিক্ষার কাঠামোগত উৎকর্ষতার ফলে প্রগতি, মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতির চর্চা ছিল হাতে হাত ধরে।
সেখানে এখন আলাপ চলছে, জামায়াতে ইসলামীর এ সহযোগী ধর্মভিত্তিক সংগঠন ছাত্রশিবির ছাত্রদের মন জয় করল কোন মন্ত্রবলে।
শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ‘কণ্ঠস্বর’ তুলে ধরতে পারবেন, সে বিবেচনা মাথায় রেখেছেন তারা। বিবেচনায় ছিল, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকাও।
এছাড়াও আগামী দিনে কী কাজ করবেন, সে বিষয়ে যারা স্পষ্ট দিশা দেখাতে পেরেছেন, তাদের প্রচার ও ইশতেহারে, তাদের দিকেই ঝুঁকেছেন শিক্ষাথীরা।
এ কারণে ডাকসুতে বিপুল জয়ের পর জাকসুতেও রায় শিবিরের পক্ষেই যায়। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মকাণ্ড যতটা আলোচনায় ছিল, এখানে ততটা ছিল না।
নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার জন্যও বছরব্যাপী পরিকল্পনা ছিল না শিবিরের। শেষ সময়ে তাদের ভিপি প্রার্থীকে বেছে নিলেও সংগঠনটির মজবুত সাংগঠনিক কাঠামো ও প্রচার-প্রচার শক্তিশালী ভূমিকা দেখাতে পারায় সহজেই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে সংগঠনটি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একজন পুলিশ সদস্য হত্যা মামলায় ১৭ বছর তিন মাস আট দিন বয়সী এক কিশোরকে রিমান্ডে পাঠানোর যে অভিযোগ উঠেছিল, সেই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজের বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম জাকসুতে শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে জিএস নির্বাচিত হয়েছেন।
ভোটের প্রচারের ক্ষেত্রে ফাইয়াজের বড় ভাই হিসেবে তার পরিচয়ও সামনে আনা হয়; ৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসটির সবমহলে মাজহারুলের পরিচিতির ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও নেপথ্যে ছিল।
ভোটের আগের দিন নিজের ফেইসবুকেও বড় ভাই ও তার প্যানেলের পক্ষে পোস্ট দেন ফাইয়াজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী মেহজাবিন হৃদি বলেন, “প্রার্থীদের মধ্যে কে আমার কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে বলে মনে হয়েছে আমার, কোন প্রার্থীর ইশতেহার আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়েছে, ইতোপূর্বে প্রার্থীদের কাজে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার কেমন পরিচয় পাওয়া গেছে—ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিবেচনা করেছি।”
শিবিরের একচেটিয়া জয় নিয়ে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজনীন বলেন, “জাহাঙ্গীরনগরকে আমরা তো সবসময় জানি যে এখানে বামধারার রাজনীতি বেশি প্রভাবশালী বা এখানে হচ্ছে বামধারার মানুষই বেশি। কিন্তু শিবির তো (নির্বাচিত) হয়েছে।
“আমরা দেখছি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা হল। এর কারণ, গত এক বছর ধরে প্রচুর পরিমাণে কাজ করেছে (শিবির)। আর এখনো করছে। যার জন্য ডাকসুর ফল নিয়ে কোনো কথা উঠে নাই। ওখানেও (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) কিন্তু একইভাবে কাজ করেছে। তো ওখানেও শিবির জয় লাভ করবে, এটা কিন্তু প্রত্যাশিতই ছিল।
অভিযোগের অন্ত নেই
জাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ পর। দিনের শুরুতে কেন্দ্রের বাইরে ভোটার উপস্থিতিও তেমন দেখা যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও ভবনের ২১টি ভোটকেন্দ্রে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ভোট শুরুর কথা ছিল। কিন্তু ব্যালট পেপার ও অন্যান্য সরঞ্জাম এনে ভোটগ্রহণ শুরু করতে করতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় পেরিয়ে যায়।
এর খানিকবাদেই আসতে শুরু করে ‘অনিয়মের’ অভিযোগ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল সংসদ নির্বাচনে ব্যালটে ভুল থাকার খবর আসে।
ভোটাররা বলেন, কার্যকরী সদস্য পদে তিনজন প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা থাকলেও ব্যালটে দেওয়া নির্দেশনায় একজনের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়েছে।
“বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে,” বলে এ ‘অনিয়মের’ কথা স্বীকারও করে নেন হলের পোলিং অফিসার উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল।
পরে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তোলে বিভিন্ন প্যানেল।
দুপুর না গড়াতেই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলা হয়। কমিশনের বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাতমূলক আচরণের’ অভিযোগ করেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী হাসান।
সেখানে ‘জামায়াতে ইসলামীর কোনো এক অখ্যাত কোম্পানি থেকে যথাযথ ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নির্বাচন কমিশন জাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার ও ভোট গণনার ওএমআর মেশিন সরবরাহ করেছে’ বলে অভিযোগ তোলেন তিনি।
নির্বাচনের প্রধান দুই উপকরণ তথা ব্যালট পেপার ও ভোট গণনার যন্ত্র কেনাকাটা নিয়ে এ অভিযোগ এলে পুরো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
বিষয়টি জানাজানি হলে চাপের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে ওএমআর মেশিনের পরিবর্তে হাতে ভোট গোনার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন।
তবে পাল্টা অভিযোগ তোলা হয় শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকেও।
দুই প্যানেলেরই ব্যাখ্যায় প্রতিষ্ঠানটির সিইও এর বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট সামনে আনা হয়।
এ অবস্থায় ভোট শেষ হওয়ার প্রায় দেড় ঘন্টা আগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
জামায়াত নেতার কোম্পানি থেকে টেলিকাস্টসহ ভিডিও ক্যামেরা সরবরাহ ও সিসি টিভির দায়িত্ব দিয়ে শিবিরকে পুরো ভোট কেন্দ্র ‘মনিটর করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে’ বলেও অভিযোগ তোলা হয়।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী এ অভিযোগ করে বলেন, “আমাদের বিজয় ব্যাহত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে এক হয়ে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ ব্যবস্থা করেছে। এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের রায়ের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটছে না। তাই আমরা নির্বাচন বর্জন করতে বাধ্য হচ্ছি।”
এ সময় আঙুলে দেওয়া অমোছনীয় কালি মুছে যাওয়া, মেঝেতে ব্যালট পেপার পাওয়ার ঘটনায় একটি হলে দুই ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। আরেকটি হলে ছাত্রদলের প্যানেলের ভিপি প্রার্থীকে প্রবেশ করতে না দেওয়ারও অভিযোগ তোলা হয় তাদের তরফে।
তবে শিবিরকে জেতাতে ভোটে ‘কারসাজি’ হওয়ার অভিযোগকে ‘হাস্যকর’ বলে তখন উড়িয়ে দেন শিবিরের জিএস প্রার্থী মাজহারুল।
তার খানিক বাদেই নির্বাচন নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত তিন শিক্ষক।
নির্বাচন বর্জনের কথা জানান, গণিত বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম ও অধ্যাপক শামিমা সুলতানা।
নজরুল ইসলাম বলেন,“আমাদের এখানে ভোট গণণার জন্য যে মেশিনটি আনার কথা ছিল, এবং যে ব্যালট ছাপানো হয়েছে, সেটা প্রমাণ সহকারে নির্বাচন কমিশনের কাছে আসছে- সেটা জামায়াতে ইসলামীর কোনো এক নেতার কোম্পানি থেকে ছাপানো হয়েছে।”
প্রমাণ পেয়ে নির্বাচন কমিশন মেশিনের মাধ্যমে ভোট গনণা থেকে সরে এসেছে বলেও তিনি তুলে ধরেন।
এর মধ্যে মো. রবিউল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী তার ‘ভোট আগেই কেউ দিয়ে গেছে’ বলে অভিযোগ তোলেন।
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, “আমি ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে এসে দেখি, আমার ভোট আগেই অন্য কেউ দিয়ে গেছে। জীবনের প্রথম ভোট এভাবে নষ্ট হবে, আমি কোনোদিন ভাবিনি।”
নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বাম ধারার শিক্ষার্থীদের চারটি প্যানেলও নির্বাচন বর্জন করে। দ্রুত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন সেসব প্যানেলের প্রার্থীরা।
চারটি প্যানেলের পক্ষে এ ঘোষণা দেন ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) সমর্থিত ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী শরণ এহসান।
এতে ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ (একাংশ), ‘সম্প্রীতির ঐক্য’, ‘সংশপ্তক পর্ষদ’, ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট প্যানেল সংহতি জানায়।
ভোট গণনার দায়িত্ব পালনে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌস।
নজিরবিহীন ভোট গণনা, শিক্ষকের মৃত্যু
জাকসুতে এবার মোট ভোটার ১১ হাজার ৮৪৩ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৬ হাজার ১১৫, ছাত্রী ৫ হাজার ৭২৮। একজন ভোটার ভোট দিতে হয় ৪০টি করে; কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি, হল সংসদে ১৫টি পদে।
এবার জাকসু ভোটের মোট প্রার্থী ১৭৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে পুরুষ প্রার্থী ১৩২ জন, নারী প্রার্থী ৪৬ জন।
মোট ২১টি হল সংসদে পদের সংখ্যা ৩১৫টি। মোট ৪৪৭ জন প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ ছাত্র হলের প্রার্থী সংখ্যা ৩১৬ জন এবং ১০ ছাত্রী হলের প্রার্থী সংখ্যা ১৩১ জন।
ভোট গণনা শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে। হাতে গুনতে গিয়ে কচ্ছপ গতিতে চলে ভোট গোনার কাজ। সে দিন সারা রাত ভোট গুনলেও খুব বেশি এগোয়নি। অনেকে সারা দিন-রাতের পরিশ্রমে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এর মধ্যে পোলিং অফিসার চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস অসুস্থ হয়ে পড়ায় শুক্রবার সকালে আসতে পারেননি। তিনি না আসায় গার্ড পাঠিয়ে তাকে ডেকে আনা হয়। তিনি এসে তৃতীয়তলায় উঠতে গিয়ে পড়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।
তার মৃত্যুর বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা সুলতানা আক্তার বলেন, “তিনি (জান্নাতুল ফেরদৌস) সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে চাপ নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। চাপের কারণে তিনি হয়তো ঘুমাতে পারেননি। সকালে অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেননি।”
ভোট গণনায় যন্ত্র ব্যবহার হলে এ শিক্ষককে হারাতে হতো না বলেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু। পরে তিনি ভিপি হিসেবে বিজয়ী হন।
সেদিন রাতে জাকসু নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে ফের নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম।
তাদের অভিযোগ, ‘মিথ্যা আর অপপ্রচার করে’ ভোট শুরুর আগেই ছাত্রদলকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। সেজন্য তারা নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন সদস্যকে দায়ী করছেন, যারা ‘বিশেষ রাজনৈতিক মতাবলম্বী’।
এতসব ঘটনার মধ্যেও শুক্রবার ভোট গণনা শেষ করা যায়নি। রাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ান নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার। সাংবাদিকদের ডেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ফার্মেসি বিভাগের এই অধ্যাপক।
শনিবার এসে ভোট গণনার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে কয়েকজন ‘অসুস্থ হয়ে পড়েছেন’ বলে তথ্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান।
তখন যন্ত্রেই ভরসা করে ভোট গণনার কাজ শেষ করা যায় কিনা এ নিয়ে বৈঠকও হয়। কিন্তু সমালোচনা এড়াতে হাতে গোনার পদ্ধতি কঠিন হলেও চালু রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
দুপুরে নির্বাচন কমিশনের আরেক সদস্য নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা পদত্যাগ করার কথা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান।
অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার শুক্রবার রাতে নির্বাচন কমিশন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
কতটা ‘গ্রহণযোগ্য’ হল নির্বাচন?
জাকসুর ভোটগ্রহণ ও ফল দিতে দীর্ঘসূত্রতার যে নজির মানুষ দেখল, তাতে নির্বাচন আসলে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হল, আদৌও হল কিনা সেটি নিয়ে আলোচনা সামনে এসেছে।
এ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক, জাকসুর নবনির্বাচিত জিএস মাজহারুল ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের তরফে মিশ্র প্রতিক্রিয়াই পাওয়া গেছে।
অব্যবস্থাপনা ও ঘটনাবহুল জাকসু নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে’ বলে মনে করেন না বলেছেন, শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচিত মাজহারুল।
এত অনিয়মের অভিযোগের পরে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য থাকল কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা কখনোই মনে করি না, এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
“আপনারা দেখতে পাবেন, প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট প্রদান করেছে।”
তিনি বলেন, “এই নির্বাচনের ভোট গণনা প্রক্রিয়া ওএমআর পদ্ধতিতে হওয়ার কথা থাকলেও সর্বশেষ ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হয়েছে। দীর্ঘ তিন দিন এই ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হয়েছে।
“আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কর্মকর্তাদের ঘাম ছুটে গিয়েছে। তবুও এই ভোট গণনা কার্যক্রমে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি চোখে পড়েনি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, “নির্বাচনে অনেক অভিযোগ এসছে, ঠিকই। কিন্তু সেরকম কোনো প্রমাণ কেউ, মানে একদম গুছিয়ে পেয়েছে, এগুলো আমি দেখি নাই। আর যারা মানে প্রশাসন উনারা তো বলছেন যে সবকিছু ঠিক আছে।
“আমার মনে হয় যে প্রথম নির্বাচন হচ্ছে এখন, এসব নির্বাচনে এগুলো অভিযোগ একটু আসবে। কিন্তু আমার মনে হয় যে নির্বাচন ঠিকই আছে। কম বেশি এরকমই হবে ফলাফল, এটাই আমাদের কাছে মনে হয়েছিল।”
তবে হাতে গণনা পদ্ধতি, শিক্ষকের মৃত্যু ও অব্যবস্থাপনার তথ্যে তিনি প্রশাসনের ‘দক্ষতার অভাব’ ও ‘বোঝার ভুল’ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক দিল রওশনের ভাষ্য, “এটা তো বহুদিন পরে নির্বাচন বা উনাদের সময় প্রথম নির্বাচন, সেজন্য প্রস্তুতির ঘাটতি একটু হয়তো ছিল বা কিছু সমস্যাও হয়তো ছিল। সেটা অনেক বেশি যে তা না।
“কিন্তু এটা হতে পারে, এটা হতেই পারে, কারণ এই সময় তো প্রথম নির্বাচন। আর ১৬ বছর কোনো নির্বাচনে ওনারা অংশগ্রহণ করতে পারেননি, এখনকার প্রশাসন। তো সেই হিসেবে, ওনাদের একটুখানি বুঝার ভুলও থাকতে পারে।”
তবে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, “দেখুন, একটা হলো যে অন্যান্য কয়েকটি প্যানেল তারা নির্বাচন বয়কট করেছে। শেষ মুহূর্তে আমরা দেখেছি দুজন শিক্ষকও করেছেন, যারা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন। একজন শিক্ষকের মৃত্যুও হয়েছে।
“তো যখন নির্বাচন কমিশনাররা খোদ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। তাদের যদি মনে হয় যে আপনার, নির্বাচন সুষ্ঠ হচ্ছে না। কারণ নির্বাচন কমিশনার খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভোটের প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকে, তারা ভোট গণনা পর্যন্ত যুক্ত থাকেন।
“আপনাকে এখানে মনে রাখতে হবে- আমরা মনে করি যে ভোট গ্রহণ শেষ হয়ে গেছে, তাহলে ভোট শেষ হয়েছে। বিষয়টা কিন্তু এরকম না। ভোটের মানে পুরো প্রক্রিয়াটাই কিন্তু। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা থেকে নির্বাচনের মানে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত। সুতরাং এই প্রক্রিয়াগুলোকে সুষ্ঠভাবে হয়েছে কিনা, নিরপেক্ষভাবে হয়েছে কিনা, কোন দলীয় চাপের বাইরে হয়েছে কিনা, কারো নিয়ন্ত্রণের বাইরে হয়েছে কিনা, স্বাধীনভাবে সেগুলো বিধিসম্মতভাবে কার্যকর হয়েছে কিনা, সেগুলো কিন্তু একটি ভোট ভালো হয়েছে কি, খারাপ হয়েছে সেটির মানদণ্ড।
“তো সে জায়গা থেকে জাহাঙ্গীরনগরে যে প্রশ্নগুলো এসেছে- আমরা দেখেছি একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটছে এবং তিন দিন লাগিয়ে ভোট গণনার রেকর্ড করানো হয়েছে, সেগুলো কিন্তু আপাততভাবে খুব বেশি মানে গ্রহণযোগ্যতার জায়গায় নেই।”
অভিযোগের ভিত্তিতে যন্ত্রে গণনা থেকে সরে আসার মাধ্যমে অভিযোগটি সত্য বলে মেনে নেওয়া হল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে এই অধ্যাপক বলেন, “জাহাঙ্গীরনগরে প্রায় ৩৩ বছর পর নির্বাচন হয়েছে।
“একটা হল যে নির্বাচনী পরিবেশ। নির্বাচন পরিচালনা যেটা, এটাও তো একটা প্রশিক্ষণের অংশ। আমি-আপনি চাইলে মানে ভোট প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে সব কাজ করতে পারব, এরকম না।
“তো সে জায়গাটায় অদক্ষতা আছে কিংবা এই অদক্ষতাকে না স্বীকার করাও যে একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেটাও কিন্তু আছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৃধা মো. শিবলী নোমান বলেন, “প্রথমত, ভোট বর্জন নিজেই এক ধরনের স্বীকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি। সেক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, ভোট বর্জনের পেছনের কারণগুলো এবং সেসবের যৌক্তিকতাও।
অন্যদিকে, একজন শিক্ষকের অকাল মৃত্যু ও শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদী পরিশ্রমের বিষয়টিকে নির্বাচন আয়োজনের নিদারুণ ব্যবস্থাপনাগত সংকটের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই সংকট বিদ্যমান ছিল।”
শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
কারো চোখে অনেক ‘যোগ্য প্রার্থীও বিজয়ী হতে না পারায় হতাশার কথা উঠে এসেছে তাদের কথায়। তবে নির্বাচন মেনে নিয়ে নির্বাচিতদের ওপর যেন আস্থা রাখতে পারেন, সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
ইফফাত রাইসা নূহা নামে একজন শিক্ষার্থী বলেন, “শিবির-সমর্থিত প্যানেল থেকে ২৫ পদের মধ্যে ২০টিতে জয় পাওয়া, আমার মতে গণহারে প্যানেল ধরে ভোট দেওয়ার প্রবণতাকেই নির্দেশ করে।
“সাহিত্য, প্রকাশনা, নাট্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অনেক যোগ্য ব্যক্তি স্থান না পাওয়ায় আমি আশাহত হয়েছি। তবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, আশা রাখব আমাদের অনাস্থার জায়গাটি তারা নিজেদের কাজের মাধ্যমে আস্থায় পরিণত করবেন।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী শিহাবুর রহমান মনে করছেন, “যারা নির্বাচন বর্জন করেছেন, তারা মূলত শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তারা এমনিতেই বর্জনের পথে হাঁটতেন। দুপুর নাগাদ অনাস্থা প্রকাশ করে বর্জন ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে তারা কেবল নিজেদের সীমাবদ্ধতাকেই প্রকাশ করেছেন। এতে আসলে কিছু যায় আসে না।
“তবে, যদি তাদের মধ্যে সত্যিকারের কিছু যোগ্য প্রার্থী থাকত, তাহলে প্রতিযোগিতা তৈরি হতো, আর সেই প্রতিযোগিতাই জাহাঙ্গীরনগরের নির্বাচনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলত। কিন্তু তারা তা না করায়, আমরা অনেককেই চিনিই না, অথচ তারা পদে জয়ী হয়েছেন। এটি আদৌ কাম্য ছিল না।”