বৃহস্পতিবার, 9 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

অথচ কুশলের সঙ্গেই শুরু হয়েছিল লিটনের

দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার মোড়ে মোড়ে ইতিহাস। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনায় ‘ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে সংরক্ষিত আছে। মাত্র ১৬ কিলোমিটারের ব্যবধানে যেমন ডাম্বুলার গোল্ডেন টেম্পল আর সিগিরিয়ার লায়ন রক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

অবশ্য ক্যান্ডি থেকে ডাম্বুলা—ঘণ্টা দুয়েকের ড্রাইভে সড়কের দুই পাশেও পুরাকীর্তির অভাব নেই।

দুই শহরের মধ্যবর্তী মাতেলায় ঢুকতেই ইন্টারসিটি উবার চালক পর্যটক ভেবে বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন সেসব দেখার। খুব একটা আগ্রহ না দেখে মাতেলার বিখ্যাত মসলা আর আয়ুর্বেদের টোপ দিলেন। পাহাড়ঘেরা আঁকাবাঁকা পথের দুই পাশে ‘স্পাইস’ আর ‘হারবাল শপে’র সামনে উৎসুক পর্যটকের ভিড়। উবারচালক বাড়িয়ে বলেননি, শ্রীলঙ্কার নানা পদের মসলার কদর ঔপনিবেশবাদকে তো আকৃষ্ট করেছিল সেই কবে!

বাংলাদেশ দলের অবশ্য সেই অবস্থা নেই।

তার ওপর শুক্রবার। পথে জুমার নামাজ ধরার পরিকল্পনা থেকে একটু বেলা করে ক্যান্ডি থেকে ডাম্বুলার উদ্দেশে রওনা হন লিটন দাসরা। জাতীয় দলের ম্যানেজার নাফিস ইকবাল বলেন, ‘জুমার কারণে দুই ভাগে আমরা রওনা করেছি। বিদেশি স্টাফরা আলাদা গেছেন।

তবে জুমার পর হাইওয়ের একটা রেস্টুরেন্টে সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করেছি।’ মসলাটসলার দোকানে ঢোকা হয়নি। বিকেল ৫টার দিকে আলিয়া রিসোর্টে উঠেছে বাংলাদেশ দল। রিসোর্ট থেকেও প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার দূরের সিগিরিয়ার বিখ্যাত লায়ন রক দেখা যায়।

কিন্তু কলম্বো, ক্যান্ডি ঘুরে ডাম্বুলায় চেক ইন করা বাংলাদেশ দলের ভেতরে পর্যটনের মানসিকতা আছে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।

দাপিয়ে গল টেস্ট খেলার পর কোথায় যেন তাল কেটে গেছে বাংলাদেশ দলের। কলম্বো টেস্টে টস জিতেও ভরাডুবি। দ্বিতীয় ম্যাচ বাদ দিলে ওয়ানডে সিরিজের ব্যর্থতার পর প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ধরাশায়ী। ডাম্বুলায় রবিবারের ম্যাচ জিতে সিরিজে সমতা ফেরাবে বাংলাদেশ দল—ভদ্রতার খাতিরেও এমন আলোচনা কোথাও শোনা যাচ্ছে না।

ম্যানেজার সরকারি প্রেস নোট ছাড়া একটি শব্দও উচ্চারণ করছেন না। প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন সরকারিভাবে কথা বলছেন, তবে সেখান থেকে অর্থবোধক কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে নিজের গড়া দল আঁকড়ে পড়ে আছেন সাবেক অধিনায়ক। অন্যদিকে দলের ব্যর্থতায় প্রধান নির্বাচককে নিয়ে জোরদার ট্রলিং চালু আছে। 

এ থেকে মুক্তির পথ একটাই—মাঠ থেকে জয় তুলে আনা। কিন্তু কিভাবে? নিজেদের অভ্যস্ত ফরম্যাট ওয়ানডেতেও এখন ছন্নছাড়া দেখায় বাংলাদেশ দলকে। টি-টোয়েন্টির গতির সঙ্গেই এখনো অভ্যস্ত হওয়া যায়নি। বাংলাদেশ দলের উপলব্ধি, ‘কিছু বুঝে ওঠার আগেই তো ম্যাচ শেষ!’

কুড়ি ওভারের সঙ্গে তাই তাল মেলাতে পারছে না বাংলাদেশ। টেস্টে বরং কিছু উন্নতি হয়েছে। তবু সময়ের তালে তালে পাঁচ দিন হাল ধরে রাখতে পারছে না। সময়ের হিসাবে এক ‘মধ্যপন্থী’ ওয়ানডের ফর্মুলাও এখন বদলে গেছে। ব্যক্তিগত ফিফটিটিফটি এ যুগে অচল। কোনো একজনকে এক শ পেরিয়ে দুইশ করার তাগিদ দেন বর্তমান কোচরা। ক্যান্ডিতে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডের আগে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং কোচ থিলান কানডাম্বি তো তেমনটাই বলেছিলেন, ‘কুশল (মেন্ডিস) ২০ বলে ফিফটি করেও ইনিংস বড় করতে পারেনি। ওকে বুঝতে হবে, এই পঞ্চাশকে ওর উচিত ছিল সেঞ্চুরি, ১৫০, পারলে ২০০ রানে নিয়ে যাওয়া।’ কুশল মেন্ডিস বুঝেছিলেন, সিরিজের ভাগ্য নির্ধারণী ম্যাচে ৭৫ বলে ফিফটি করে তিনি আউট হয়েছিলেন ১২৪ রানে। ততক্ষণে বাংলাদেশকে খাদের একেবারে কিনারায় ঠেলে দিয়েছিলেন কুশল মেন্ডিস।

বাংলাদেশের বিপক্ষে চলমান সিরিজে লাল ও সাদা বলে কুশলের স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ১২৪, ৫৬, ৪৫, ৬৪ এবং গল টেস্টের একমাত্র ইনিংসটিতে ৫। কোনো সিরিজে এমন ধারাবাহিক একজন ব্যাটার থাকলে দলের পক্ষে কাজটা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ব্যাটারই ধারাবাহিক নন। ক্যালেন্ডার ধরে একেক দিন একেকজন কিছু রান করেন। তাতে ঘুরেফিরে পুঁজি সমান, যা দিয়ে লড়াইও করা যায় না। 

কেন এমন হচ্ছে? বাংলাদেশ দল থেকে সরকারি ব্যাখ্যার কোনো মানে দাঁড়ায় না। ঘুরপথে খোঁজ নিলে বোঝা যায়, এই ব্যর্থ সফরে দলের ম্যানেজমেন্টও কমবেশি অনিশ্চয়তায় ভুগছে। প্রতিভায় খুব পিছিয়ে নেই। কিন্তু মাঠে সেসবের বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে না। অনেক চাপাচাপির পর একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে শুধু বলেছেন, ‘অ্যাপ্লিকেশনটা হচ্ছে না।’

অথচ এই প্রয়োগক্ষমতাই সাফল্যের চাবিকাঠি। শ্রীলঙ্কার চারিথ আশালঙ্কা এবং বাংলাদেশের মেহেদী হাসান মিরাজ একই বিশ্বকাপে যুবদলের অধিনায়ক ছিলেন। কুশল মেন্ডিস ও লিটন দাস একই যুব বিশ্বকাপে নিজেদের আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন। প্রায় এক দশক পর এই চারজনের অবস্থা দেখুন। কুশল মেন্ডিস ও আশালঙ্কাকে শ্রীলঙ্কা মনে করছে ভবিষ্যতের তারকা। সমসাময়িক এ দুজনের তুলনায় লিটন ও মিরাজের অবস্থান না বললেও চলছে!

তাতে সামনে চলে আসছে পুরনো প্রশ্নটি, যুবদল থেকে জাতীয় দলে যাওয়ার পথে কী ঘটে বাংলাদেশে? ঢালাও একটি অভিযোগ আছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ঠিকঠাক পরিচর্যা করে না যুবদলের ক্রিকেটারদের। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোতেও ঘাটতি আছে। 

সেই ঘাটতি কতটুকু? প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের উইকেট আগের তুলনায় ভালো হয়েছে। আম্পায়ারিং নিয়ে পুরনো অভিযোগ শোনা যায় না। বর্তমান বোর্ড সভাপতি আমিনুল ইসলাম খেলোয়াড়ি জীবনে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বেতন তো দূরের কথা, ম্যাচ ফিও পেতেন না। দৈনিক ভাতা ছিল ৪০০ টাকা। এখন বেতন আছে, আছে ম্যাচ ফি ও দৈনিক ভাতা। সব মিলিয়ে আমিনুলের জমানার চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ গুণ বেশি আর্থিক সুবিধা পান এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। বিনিময়ে জাতীয় লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কতটুকু বেড়েছে?

কলম্বো টেস্টের পর অধিনায়কত্ব ছাড়ার আগে নাজমুল হোসেন একটা সত্যি প্রকাশ করে গেছেন, ‘শুধু অবকাঠামো আর এটা-সেটা বললে হবে না। আমাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় না। তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ম্যাচে ফেরার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। ওখানে আমাদের সবার মনোযোগ দিতে হবে।’

এটাই, বেতন-ভাতা বাড়লেও দুলকিচালে চলে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। একটা সেঞ্চুরি করলে ব্যাটারের নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া টিম হৈচৈ ফেলে দেয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরীক্ষা আর দিতে হয় না তাকে। চাপে পড়ে নির্বাচকরা সেই ব্যাটারকে দলে নিয়ে চরম অপদস্থ হন।

বাংলাদেশ দল হারে। এরপর প্রশ্ন ওঠে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে। এই মান বাড়ানোর বেশির ভাগ দায় ক্রিকেটারদের। এর আগে-পরে কোনো ‘যদি’, ‘কিন্তু’ নেই!

কুশল মেন্ডিস আর লিটন দাসের বেড়ে ওঠা দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। দুজনের যুবদল, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ২০১৪ যুব বিশ্বকাপে আলো ছড়ানোর পরের বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক দুজনের। লিটনের মতো কুশল মেন্ডিসকেও তীব্র সমালোচনা সইতে হয়েছিল ধারাবাহিকতার অভাবের কারণে। শুধু তা-ই নয়, সেট হয়ে আউট হওয়া নিয়েও। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ফালতু শট খেলে দলকে বিপদে ফেলা—মেন্ডিস আর লিটন যেন ছিলেন একই বৃন্তের দুটি পাতা! সেই পর্ব পেরিয়ে কুশল মেন্ডিস এখন শ্রীলঙ্কার আগামী দিনের কিংবদন্তি হতে চলেছেন। অথচ লিটন আজ কোথায়? একই প্রশ্ন কি লিটনের মনেও উঁকি দেয়?

 

সর্বাধিক পঠিত