বৃহস্পতিবার, 9 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

স্বাস্থ্য খাতে এক বছরে ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ১১ শতাংশ

স্টাফ রিপোর্টার : করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানো এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে ২০২০ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের অধীনে দেশের ৫০ জেলা হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ স্থাপন করার কথা। গত পাঁচ বছরে স্থাপন করা হয়েছে মাত্র ১৩টি হাসপাতালে। যেসব হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। আইসিইউ পরিচালনার মতো দক্ষ চিকিৎসক ও নার্স নেই। এ কারণে এসব হাসপাতালের আইসিইউ কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আইসিইউ চালু করা না হলে ইতোমধ্যে কেনা যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণে প্রকল্পের আওতায় যত অর্থ ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে, তা গচ্চা যেতে পারে।

প্রকল্পটির ওপর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় মূল্যায়নে এ রকম আরও কিছু দুর্বলতার চিত্র উঠে আসে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গুরুতর অসুস্থ শিশুদের জন্য ১৬টি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ) স্থাপনের কথা ছিল প্রকল্পের আওতায়। বাস্তবে একটিও পিআইসিইউ স্থাপন করা হয়নি। এ প্রতিবেদনের বাইরে বৈদেশিক ঋণ সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্প অডিট অধিদপ্তর প্রকল্পটির কেনাকাটায় ৪৬৪ কোটি টাকার অডিট আপত্তির কথা জানিয়েছে।


আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ৫ আগস্টের পর ঠিকাদারের পালিয়ে যাওয়া এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন দুর্বলতার অন্যতম কারণ। অন্য বড় কারণ হিসেবে নতুন করে নকশা প্রণয়ন, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব ও বারবার প্রকল্পের পরিচালক পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়। গত পাঁচ বছরে মোট সাতজন প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ নামে প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় দুবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। শেষ দফায় প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০২৫ সালের ৩০ জুন। প্রকল্পটির অনুমোদিত ব্যয় ৬ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে বিদেশি ঋণ ৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবি এই ঋণ দিয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ প্রকল্পের মতো স্বাস্থ্য খাতের অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে রুগ্‌ণ দশা রয়েছে। এ প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অবকাঠামো খাতের চেয়েও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা জোর দিয়ে বলা হয়। বাস্তবে ঘোষিত অগ্রাধিকারে কোনো প্রতিফলন নেই কোথাও। স্বাস্থ্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পেছনে পড়েছে এই খাত।

২০২৪-২৫ অর্থবছর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ১৯ প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত বরাদ্দের (আরএডিপি) ২১ শতাংশ, অর্থাৎ ৭৯ শতাংশই অব্যয়িত। খরচ করতে না পারা অর্থের পরিমাণ চার হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। আর মূল এডিপি বিবেচনায় নিলে ব্যয় মাত্র ১১ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে অব্যয়িত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। 
জানতে চাইলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প ব্যয় কম হওয়ার কারণ হচ্ছে, বড় ক্রয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা। এ কারণে খাতভিত্তিক ব্যয়ের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নতুন করে পাঁচ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে আগামীতে এ খাতের এডিপি বাস্তবায়নের দুর্বলতা অনেকটাই কেটে যাবে।

স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নের অনিয়মের আরও কিছু তথ্য উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত আইএমইডির অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। পণ্য বুঝে না পেয়েও ঠিকাদারের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।

আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়টি স্পষ্ট। বিভিন্ন প্রকল্পে ধীরগতি রয়েছে। এসব দুর্বলতা দূর করতে পদক্ষেপ নেবেন তারা। স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকারের খাতে এত সব অনিয়ম ও দুর্বলতার দায় কার, কেন অর্থ ব্যয় করা যায় না– এসব বিষয়ে চেষ্টা করেও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব কিংবা ঊর্ধ্বতন কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। 
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতের অনাকাঙ্ক্ষিত নাজুক অবস্থার জন্য অনেকের দায় আছে। মূল সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট দেখে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়। এসব পিডি নিয়োগকর্তাদের খুশি রাখতে প্রকল্পের অর্থের প্রথম কিস্তি ব্যয় করে থাকেন। মাঝপথে পিডির পরিবর্তনও প্রকল্প বাস্তবায়ন ধীর করে দেয়। আবার কেনাকাটায় আছে সিন্ডিকেট। নির্দিষ্ট ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের কাজ দিতে হয়। তারা চালাকি করে সময়মতো কাজ করে না। যাতে সময়ক্ষেপণ করে ব্যয় বাড়লে বাড়তি আয় করতে পারে। এ কারণেও প্রকল্পে গতি ধীর হয়। সরকারি সিস্টেমের দায়ও আছে।

 

সর্বাধিক পঠিত