না হয় তিনি প্যারিস ছেড়েছেন, কিন্তু ফ্রান্সের অদৃশ্য জার্সি তো গায়ে সব সময়ে। বিশ্বকাপ এনে দেওয়া সেই আদরের ঘরের ছেলেই কিনা এখন ফরাসিদের কাছে ‘চোখের বালি’। পিএসজির সমর্থকরা এখন তাঁকে দেখলেই দুয়ো দেন, কথা শুনিয়ে দেন বিশ্বাসভঙ্গের সুরে।
নিউইয়র্কের মেটলাইফ স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে থাকা এক ফরাসি দর্শকের একটি ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল। যেখানে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে উদ্দেশ করে গ্যালারির খুব কাছ থেকে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমাকে ছাড়াই প্যারিস ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন, তোমাকে ছাড়াই জাদু দেখাতে পারে প্যারিস...।’
ম্যাচে পিএসজি তখন ৩-০ গোলে এগিয়ে, দর্শকের কথাগুলো বোধ হয় শুনতে পান এমবাপ্পে। অসহায়ের মতো সেদিকে তাঁকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। ভেতরে তখন কী চলছিল এমবাপ্পের? শেষ বয়সে অটোবায়োগ্রাফিতে না লিখলে হয়তো কখনোই তা জানা যাবে না। তবে বাইরে থেকে আন্দাজ করা যায় ছেড়ে আসা প্রাক্তনের মন– জানতে চাইছে তুমি সুখে আছো তো?
অসুখী হয়তো নন তিনি, তবে প্রাপ্তি যে তাঁর অপূর্ণ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিততে চান বলে পিএসজির বাবুই পাখির বাসা ভেঙে রিয়াল মাদ্রিদের চড়ুইয়ের মতো অট্টালিকা বেছে নিয়েছিলেন নিজেই। ভিনি, বেলিংহাম, টনি ক্রুজ, মডরিচদের নিয়ে চ্যাম্পিয়ন লিগের মুকুট তখন রিয়ালের মাথায়, প্যারিসের ভালোবাসা ছেড়ে তিনি তখন বেছে নেন সেই রিয়াল মাদ্রিদকেই।
এখানে এসেই ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ৩৪ গোল করেছেন। তবে ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সেই রিয়ালেই কিনা এবার ট্রফিশূন্যতার খরা! না জুটেছে লা লিগা, না চ্যাম্পিয়ন লিগ– মুখ রক্ষার জন্য যা একটু আশা ছিল ক্লাব বিশ্বকাপে, সেটিও হাতছাড়া। তাও আবার সেই প্রাক্তনের কাছেই!
কবিগুরুর ভাষায়, ‘সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।/ শুধু সুখ চলে যায়।/...এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।’ কিন্তু এমবাপ্পের চাওয়াটা কি অন্যায় কিছু ছিল? ছেলেবেলায় যে ক্লাবের তারকার পোস্টার শোবার ঘরে রেখে ঘুমাতেন, সেই এমবাপ্পে তো খুঁজে নেবেনই তাঁর স্বপ্নের ঠিকানা। যে ক্লাবে জিদান, রোনালদোর নাম মিশে আছে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে, সেখানে যেতে চাইবেনই তিনি। এটা যতটা না মোহ, তার চেয়েও বেশি অনুরাগ। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের প্রতি তাঁর আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অনৈতিকতারও কিছু নেই।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম কখনও স্বদেশি ক্লাবের প্রতিপক্ষ হয়ে, কখনও শৈশবের ক্লাবের বিপক্ষ দল হয়ে মাঠে নামতে হচ্ছে। কিন্তু এমবাপ্পের বেলাতেই কেন বারবার খোটা শুনতে হচ্ছে? বেশ কয়েক মাস আগে রেডিও মার্কার এক অনুষ্ঠানে এক ফরাসি সাংবাদিক একটা কারণের কথা বলেছিলেন। যার একটা এমন– কিলিয়ান প্যারিস ছেড়ে আসার সময় পিএসজিকে অবজ্ঞা করে এসেছে। সে মনে করেছে, পিএসজিতে থাকলে ক্যারিয়ারে সে কখনোই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারবে না, যা কিনা পিএসজির সমর্থক ছাপিয়ে অনেক ফরাসির মনে আঘাত করেছে।
তাছাড়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখোর সঙ্গে কিলিয়ানের বন্ধুত্ব তো রয়েছে। মাঁখোই নাকি হাত ধরে বলেছিলেন, দেশের ফুটবলের স্বার্থে কিলিয়ানকে পিএসজিতে থাকতে। তবে এমন একটা খবর বছর তিনেক আগেই ফরাসি গণমাধ্যমে এসেছিল। ২০২২ সালে মাঁখোর অনুরোধেই নাকি এমবাপ্পে এক বছর চুক্তি বাড়িয়ে ছিলেন পিএসজির সঙ্গে। কিন্তু শেষের দিকে পিএসজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে অবিশ্বাস চলে আসে।
পিএসজি চাইছিল, চুক্তির অপশনাল অতিরিক্ত এক বছর তাঁকে সৌদি ক্লাব আল হিলালের কাছে রেকর্ড ৩০০ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রি করে দিতে। তাতে রাজি ছিলেন না এমবাপ্পে। তখন একরকম মানসিক নির্যাতন করা হয় তাঁর ওপর। ‘লোফটিং’– ফ্রান্সে এই শব্দটি বলতে বোঝায়, কোনো খেলোয়াড়কে খেলার বাইরে রেখে প্রশাসনিক বা শাস্তিমূলক কারণে একঘরে করে রাখা। এমবাপ্পে এই ‘অপমানজনক আচরণে’ ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেন।
যদিও নিউইয়র্কে পিএসজির বিপক্ষে মাঠে নামার আগে সেই মামলা প্রত্যাহার করে নেন। ইঙ্গিত দেন, সম্পর্কের সবটুকু এখনও ছিন্ন হয়ে যায়নি। তবে প্যারিসের প্রসিকিউটর দপ্তর জানিয়েছে, পিএসজির বিরুদ্ধে তাঁর বকেয়া ৫৫ মিলিয়ন ইউরোর আর্থিক মামলাটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইব্যুনালে এখনও চলমান।
প্যারিসে সাত বছর কাটিয়ে ছয়টি লিগ শিরোপা জিতিয়ে আর্থিক এই দাবিটুকু ‘ছেড়ে দিলাম’ বলতেই পারতেন; কিন্তু পিএসজির শেষ বছরটিতে তাঁর সঙ্গে চলা ঘটনাগুলো এখনও যেন মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না এমবাপ্পে।
মাদ্রিদে এই মৌসুমে হয়তো তাঁর হাত শূন্য, কিন্তু আরও যে চারটি বছর পড়ে আছে সামনে। তখন মাদ্রিদের কোনো অর্জনে এমবাপ্পেকে নিয়েই হয়তো কবিতা লিখবে প্যারিস। ফ্রান্সের জার্সিতেই এমবাপ্পের কোনো সফলতায় অভিমান ভুলে আবারও হয়তো ছবি আঁকা হবে তাঁর। শত হলেও এমবাপ্পে তো প্যারিসেরই আপনজন। প্রিয়জন সুখী থাকবে বলেই তো ছেড়ে দিতে হয়।