ফুলকি ডেস্ক : মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রতিহিংসা আর শত্রুতার কাহিনি নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই অন্ধকার পৃথিবীতে এমন এক আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত হয়েছিল, যিনি শত্রুদের প্রতিও দয়ার স্রোত প্রবাহিত করেছিলেন। তিনি হলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর জীবন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য দয়ার আদর্শ।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁকে ঘোষণা করেছেন—
“وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ”
‘আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
বদর ও উহুদের উদারতা
বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়লাভ করার পর বন্দী শত্রুদের প্রতি দয়ার আচরণ পৃথিবীকে অভিভূত করে। নবীজি (সা.) তাঁদের হত্যা করার নির্দেশ দেননি; বরং বন্দীদেরকে মুসলমানদের ঘরে ভাগ করে দেন এবং সাহাবীগণ তাঁদেরকে নিজেদের চেয়ে উত্তম খাদ্য খাওয়ান। কোরআনের নির্দেশে বন্দীদের প্রতি সদাচরণ করার বিবরণ কোরআনের সুরা দাহরের ৮ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
এই সদাচরণের ফলে অনেকে পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
উহুদের যুদ্ধে নবীজি (সা.)-এর দাঁত ভেঙে যায়, মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়। তখন সাহাবীগণ অভিশাপ দেওয়ার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু তিনি বললেন:
إِنِّي لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً
“আমি অভিশাপ দিতে আসিনি; বরং রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।
” (সহীহ মুসলিম, ২৫৯৯)
শত্রুর হাতে এমন ক্ষতবিক্ষত হয়েও তিনি তাঁদের জন্য হিদায়াত কামনা করেছেন।
তায়েফের মহিমা
তায়েফের মানুষ তাঁকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং পাথর ছুঁড়ে রক্তাক্ত করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে নবীজি (সা.)-এর কাছে পাহাড়ের ফেরেশতা প্রস্তাব করেছিলেন, চাইলে পুরো শহরকে পাহাড় চাপা দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি দোয়া করলেন:
“হে আল্লাহ! এরা জানে না, হয়তো তাঁদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন মানুষ আসবে যারা আপনাকে উপাসনা করবে।” (সহীহ বুখারী, ৩২৩১)
এই মহান দয়ার কারণে পরবর্তীতে তায়েফ ইসলাম গ্রহণ করে।
মক্কা বিজয়ের পর অভাবনীয় ক্ষমা
নবীজি (সা.)-এর দয়ার শীর্ষ প্রকাশ ঘটে মক্কা বিজয়ের দিনে। যারা তাঁকে ও তাঁর সাহাবীদের উপর বছরের পর বছর নির্যাতন চালিয়েছিল, হত্যা করেছিল, ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছিল—তাঁদের সামনে নবীজি (সা.) দাঁড়িয়ে বললেন:
“আজ তোমাদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ নেই। যাও, তোমরা সবাই মুক্ত।” (ইবনে হিশাম)
এ যেন মানবতার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমার ঘোষণা।
এসব ঘটনায় আমাদের জন্য শিক্ষা
• নবীজি (সা.) দেখিয়েছেন যে প্রতিশোধ নয়, দয়া ও ক্ষমাই শত্রুর হৃদয় জয় করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
• তাঁর এই আচরণ কেবল এক ব্যক্তির চরিত্র নয়, বরং ইসলামি সভ্যতার নৈতিক ভিত্তি।
• শত্রুর প্রতি দয়া প্রদর্শন মানে দুর্বলতা নয়; বরং মহানুভবতার চূড়ান্ত রূপ।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন আমাদের শেখায়—বিদ্বেষকে ভালোবাসায় পরিণত করা সম্ভব। শত্রুকে শত্রু হিসেবে নয়, বরং একজন অজ্ঞাত-অহিদায়তপ্রাপ্ত মানুষ হিসেবে দেখাই তাঁর পদ্ধতি। পৃথিবী আজও যখন সংঘাত, প্রতিহিংসা আর যুদ্ধের অগ্নিকুণ্ডে জ্বলছে, তখন তাঁর দয়ার্দ্র আচরণের শিক্ষা মানবতার জন্য অমোঘ প্রেরণা। তিনি আমাদের জন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন, আর সেই উদাহরণই হলো—ক্ষমা, দয়া ও করুণার মাধ্যমে বৈরিতাকে দূর করা।