স্টাফ রিপোর্টার : দুর্বল পাঁচ ইসলামী শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংক মিলে একটি রাষ্ট্র মালিকানার ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় হবে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূলধন হিসেবে সরকার দেবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আসবে আমানত বীমা তহবিল এবং এসব ব্যাংকে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের মাধ্যমে। পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ কার্যক্রমটি আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে শেষ করতে চায় সরকার। এ জন্য সময়ভিত্তিক কর্মকৌশল চূড়ান্ত করতে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক মিলে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার রূপরেখার খসড়া নিয়ে গতকাল রোববার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. কবির আহম্মদসহ অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একীভূতকরণ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। তবে বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি। তবে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হওয়া নিয়ে বিরোধিতা আসে। শেষ পর্যন্ত সার্বিক অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রস্তাবে সম্মত হয় সরকার।
বৈঠকে জানানো হয়, একীভূতকরণ বিষয়ে ইতোমধ্যে পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে তিন ব্যাংক একীভূতকরণে সম্মত হলেও এক্সিম এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক আপত্তি তোলে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ব্যাংক দুটি পর্যাপ্ত মূলধন জোগাড় করে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে তাদের একীভূতকরণের আওতায় আনা হবে না। কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হয়নি। উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরও টাকা চাচ্ছে। ইতোমধ্যেই তাদের দেওয়া টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে আর টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই। ব্যাংক দুটির সুবিধাতেই একীভূতকরণের আওতায় তাদের রাখা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়ভিত্তিক কর্মকৌশল চূড়ান্ত করে ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহম্মদের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধিও রাখা হয়েছে। এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের আলোকে এ কার্যক্রম চালালেও গতকালকে বৈঠকের মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ কার্যক্রমে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সম্মতি পাওয়া গেল।
ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহম্মদ বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণের অধিকাংশ কাজ শেষ করা হবে। তবে পরিপূর্ণভাবে এ কাজ শেষ করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত একটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার ধারণা নিয়েই তারা এগোচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, পাঁচ ব্যাংককে একীভূতকরণে প্রাথমিক পর্যায়ে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে মূলধন হিসেবে সরকার দেবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাজেট থেকে দেওয়া হবে ২০ হাজার কোটি এবং ২০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঅর্থায়ন তহবিল থেকে। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাঁদার টাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে গড়ে ওঠা আমানত বীমা তহবিল থেকে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে। বাকি সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার জন্য এসব ব্যাংকে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের আমানত শেয়ারে রূপান্তরিত করা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের ১০ শতাংশ শেয়ারে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওয়ার্কিং কমিটির কার্যপরিধি বিষয়ে কবির আহম্মদ বলেন, একটি নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লাইসেন্স, আরজেএসসি থেকে নিবন্ধনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম প্রয়োজন হয়। এসব বিষয় কখন কীভাবে করা হবে সে বিষয়গুলো নিয়ে সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করবে। তিনি আরও বলেন, সার্বিক কার্যক্রমে আমানতকারীদের শতভাগ স্বার্থ ও ব্যাংকগুলোতে কর্মরতদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজন না হলেও পরবর্তী সময়ে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ‘পুনরুদ্ধার তহবিল’ হিসেবে অর্থ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের।
একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের সম্মতি পাওয়ায় এবার ব্যাংকগুলোর পর্ষদ বাতিল করে আলাদা একটি পর্ষদ গঠন করা হবে। নতুন ব্যাংকটির সরকারের পক্ষে পরিচালনগত দিক দেখাশোনা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন পর্যায় থেকে তহবিল নিয়ে ব্যাংকটি তিন থেকে পাঁচ বছর সরকারি মালিকানায় চলবে। এরপর বেসরকারি খাতে বিক্রি করে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোনো সংস্থা নতুন ব্যাংকের মালিকানায় যুক্ত হতে পারে। ব্যাংকটি বিক্রির পর মুনাফাসহ সরকারের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। নতুন ব্যাংকের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং, আর্থিক খাত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ একজনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে। পাঁচটি ব্যাংকের অনেক ক্ষেত্রে একই এলাকায় একাধিক শাখা রয়েছে। এতে করে কর্মী ছাঁটাইয়ের একটি প্রশ্ন আসবে। তবে কর্মীদের গণহারে যেন ছাঁটাই করতে না হয়, সে লক্ষ্যে গ্রামীণ এলাকায় নতুন শাখা খোলা হবে। এ ছাড়া কোনো এলাকা থেকে সংগৃহীত আমানতের বেশির ভাগ সেই এলাকায় বিনিয়োগ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। শতাংশ বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীর ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ শতাংশ খেলাপি। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার হিসেবে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী নিয়েছে সাত হাজার ৫০ কোটি, এসআইবিএল ছয় হাজার ৬৭৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী দুই হাজার ২৯৫ কোটি ও ইউনিয়ন ব্যাংককে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।