বুধবার, 26 নভেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

ইসরায়েলি আগ্রাসন আতঙ্ক, মৃত্যু ও দাফনের শহর গাজা

ফুলকি ডেস্ক : ক্ষুধা-অপুষ্টিতে গাজার শিশুদের ওজন ভয়ানক কমে যাচ্ছে। শিশু আলী আবু আজরার ওজন এখন হওয়ার কথা ছিল ১৩ কেজি। এখন তার ওজন মাত্র তিন কেজি। ১৮ মাস বয়সী আলী তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। সে ইসরায়েলের সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে ভর্তি শিশুটি দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির শিকার। এ কারণে তার শরীরের চর্বি এবং পেশী টিস্যু কমে গেছে। যার ফলে তার ত্বক হাড়ের সঙ্গে লেগে আছে।

তার মা আনাদোলু এজেন্সিকে জানান, তার ছেলে আলী দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, ফুসকুড়ি, ঘন ঘন জ্বর, খিঁচুনি এবং তীব্র ক্যালসিয়ামের ঘাটতিতে ভুগছে। কারণ গাজা উপত্যকায় খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশের ওপর ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞা চলমান রয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তার ওজন এক কেজি কমে গেছে। দুধ নেই, ওষুধ নেই। প্রতিদিন পানিশূন্যতা ও অপুষ্টিতে তার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি সন্তানের বিদেশে চিকিৎসায় তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। গাজার হাসপাতালের কয়েক ডজন শিশু একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি।

ফিলিস্তিনের গাজা এখন আতঙ্ক, মৃত্যু ও দাফনের শহরে পরিণত হয়েছে। নারী-শিশুদের জন্য শহরটি এখন শঙ্কাজনক স্থানে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলার মুখে বাসিন্দারা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল- ইউনিসেফ জানিয়েছে, এই শহর এখন শিশুদের জন্য অসম্ভব আতঙ্কের। এই অবস্থায় ইসরায়েলি বাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, তারা শহরটির ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সর্বশেষ হামলায় শহরের বিভিন্ন স্থানে সাত শিশু নিহত হয়েছে।


ইউনিসেফের মুখপাত্র টেস ইনগ্রাম বলেছেন, গাজা শহরের মৌলিক পরিষেবা ভেঙে পড়েছে। ক্ষুধা-অপুষ্টি শিশুদের শরীর দুর্বল করে দিচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হওয়ায় তারা নিরাপদ আশ্রয় হারিয়ে ফেলেছে। মৌলিক অধিকারের ওপর আঘাতের ফলে তারা যত্ন থেকেও বঞ্চিত। গোলাগুলি তাদের প্রতি মুহূর্তের চলাচলকে হুমকির মুখে ফেলছে।

ইসরায়েল গাজা শহরে অভিযান জোরদার করায় জাতিসংঘ গভীর বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্ক করেছে। গত ১৪ থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে ৮২ হাজারের বেশি মানুষ নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ উত্তর থেকে দক্ষিণ গাজায় চলে গেছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জেনেভায় জাতিসংঘের অংশীদারদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ক্রমবর্ধমান শত্রুতা ও বাস্তুচ্যুতি গাজা শহরে বসবাসকারী মানুষের জন্য ভয়াবহ মানবিক পরিণতি বয়ে আনছে।  

বাসিন্দারা জেইতুন, সাবরা, তুফাহ এবং শেজাইয়ায় ভারী বোমাবর্ষণের খবর পেয়েছেন। ট্যাঙ্কগুলো শহরের কেন্দ্রস্থলের উত্তর-পশ্চিমে শেখ রাদওয়ানে অগ্রসর হয়েছে। 
ঘরবাড়ি ভেঙে ও শিবিরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। গাজার বেসামরিক জরুরি পরিষেবার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, বোমা হামলার শিকার হচ্ছে বেসামরিক নাগরিক। গাজা শহরের চারটি বড় ভবন ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী পূর্ব শহরতলিতে আরও গভীরে প্রবেশ করেছে।  

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা গাজা শহরের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা পুরো এলাকা দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডিফ্রিন এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা হামাসের অবকাঠামোর ক্ষতি অব্যাহত রেখেছি। আমরা গাজা শহরের ৪০ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করেছি। যুদ্ধের সমস্ত লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমরা অভিযান চালিয়ে যাব। হামাসের শাসন ভেঙে ফেলে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে চাই।’

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দখলদার বাহিনীর হামলায় অন্তত ১০৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে শুক্রবার ৪৪ জন নিহত হন। হামলায় নিহতদের অন্তত ৩০ শতাংশ শিশু। গত ২৩ মাসে কমপক্ষে ৬৪ হাজার ২৩১ জন নিহত ও ১ লাখ ৬১ হাজার ৫৮৩ জন আহত হয়েছে।

সাত শিশুকে হারিয়ে বিগলিত ‘হৃদয়’ গাজাবাসীর 
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে ইসরায়েল গাজা শহরের বেশ কয়েকটি অস্থায়ী তাঁবু, অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক এবং আবাসিক ভবন লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। নিহতদের মধ্যে সাত শিশুও রয়েছে। হামলায় মাহা আফানার ছেলে-মেয়ে দুজনেরই প্রাণ গেছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি আমার ছেলের খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, সে পড়ে আছে, তার নাক দিয়ে ও মাথার পেছন থেকে রক্ত ঝরছে। আমি চিৎকার করতে শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘তারপর আমি আমার দ্বিতীয় সন্তান- আমার মেয়ে নূরকে দেখতে পাই। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তে ভেজা ছিল।’

‘নরকের দরজা খুলে যাচ্ছে’ 
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, গাজায় ‘নরকের দরজা’ খুলে যাচ্ছে। কারণ সেনাবাহিনী গাজা শহরের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে একটি উঁচু টাওয়ার ধ্বংস করেছে। তারা ঘোষণা করেছে, রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ দখলের অভিযান তীব্রতর করার পাশাপাশি আরও বহুতল ভবন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হবে।

প্রধান ভবনটির নাম মুশতাহা টাওয়ার। এটি গাজা শহরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত একটি ১২ তলা ভবন এবং শত শত অস্থায়ী তাঁবু দ্বারা বেষ্টিত। কারণ শহরের এই অংশটিকে পূর্ব উপকণ্ঠে বোমাবর্ষণ থেকে পালিয়ে আসা পরিবারগুলোর জন্য শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

কাটজের মন্তব্য গাজা সিটিতে বোমাবর্ষণ অভিযানের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত ভয়াবহ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, কারণ  মারাত্মক বিমান হামলার নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে, যা মূলত গাজা সিটির উঁচু টাওয়ারগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে।  ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এরকম শতশত ভবন রয়েছে।

তিন ফিলিস্তিনি সংস্থার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ দেওয়ায় তিন ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজা যুদ্ধ ও ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্তে সহযোগিতা করার অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা। সংস্থাগুলো হলো রামাল্লাভিত্তিক আল-হক, গাজা নগরভিত্তিক প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (পিসিএইচআর) ও আল-মিজান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস। বৃহস্পতিবার মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় সংস্থাগুলোর নাম যুক্ত করা হয়। এ বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, এসব সংস্থা ইসরায়েলের সম্মতি ছাড়াই আইসিসির তদন্ত, গ্রেপ্তার ও বিচারপ্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিল।
 
হামাসের প্রস্তাব খারিজ করল ইসরায়েল 
গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির জন্য হামাসের দেওয়া বিস্তৃত চুক্তির প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এই প্রস্তাবকে হামাসের আরেকটি নতুন চাল বলে অভিহিত করেছে। পাশাপাশি নতুন করে কিছু শর্ত দিয়েছে ইসরাইল। তাদের দাবি, যুদ্ধ তখনই শেষ হবে যখন সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং হামাসকে পুরোপুরি অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে। এছাড়া গাজায় বিকল্প বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছে তেল আবিব। হামাস তাদের প্রস্তাবে জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি, ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার, সীমান্ত ক্রসিংগুলো পুনরায় চালু করা এবং গাজার পুনর্গঠন শুরু করার দাবি জানিয়েছে।  

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে: রুবিও 
এএফপি জানায়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বৃহস্পতিবার বলেছেন, ফিলিস্তিনকে আলাদা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিলে তা আরও সমস্যা তৈরি করবে। অন্যান্য দেশকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি এই স্বীকৃতি দেন, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং কাল্পনিক, তবে আপনারা সমস্যা তৈরি করবেন। কুইটোতে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নোবোয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর এসব কথা জানান রুবিও।   

ইসরায়েলে বিক্ষোভ গড়াল ৭০০তম দিনে  
৭০০ দিন ধরে ইসরায়েলে চলছে নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভ। শুক্রবারও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল তেল আবিব। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হামাসের হাতে জিম্মি থাকা বাকি ইসরায়েলিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে বলে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে তারা। টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, তেল আবিবের হোস্টেস স্কয়ারে বিশাল আকৃতির একটি ‘এসওএস’ সাইন প্রদর্শন করে রেখেছে বিক্ষোভকারীরা।

 

সর্বাধিক পঠিত