স্টাফ রিপোর্টার : আসন্ন নতুন শিক্ষাবর্ষে বিনা মূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দিতে প্রায় তিন মাস দেরি হওয়ায় শিক্ষা বিভাগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সেই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এবার বই ছাপানোর কাজের প্রক্রিয়া আগেভাগেই শুরু করেছিল এনসিটিবি। নভেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপিয়ে মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যও ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির (ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম) পাঠ্যবইয়ের দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ায় পুরো পরিকল্পনাটিই এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
এর ফলে জানুয়ারিতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তারাই নিশ্চিত নন। তাঁদের মতে, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই আবার দরপত্র দিয়ে ছাপিয়ে বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া কঠিন হবে।
এনসিটিবির সূত্র জানায়, আগামী বছর বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই প্রায় ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখ বই প্রয়োজন হবে। এবার মোট বইয়ের সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কম। দরপত্রের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে মূল্যায়নের কাজও সম্পন্ন করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু সম্প্রতি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপানোর দরপত্র বাতিল করা হয়। তবে কী কারণে তা বাতিল করা হয়েছে, এনসিটিবিকে সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৬, সপ্তম শ্রেণির ৪ কোটি ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯২ এবং অষ্টম শ্রেণির ৪ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮। এর মধ্যে ২৮০টি লটের মধ্যে ১১ কোটির বেশি বই ছাপানোর দরপত্র বাতিল হয়েছে।
দরপত্রসংক্রান্ত একটি ধারাও সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, এমন খবরের পর আলোচনা শুরু হয় যে মাধ্যমিকের এই তিন শ্রেণির বই ছাপার কাজ আন্তর্জাতিক দরপত্রে হতে পারে। এ নিয়ে গত রোববার রাজধানীর মতিঝিলে এনসিটিবি ভবনের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে।
তবে বিক্ষোভের আগমুহূর্তে এনসিটিবি এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, সম্প্রতি কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানসংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবরের যথার্থতা নেই। এ ধরনের সংবাদে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছে এনসিটিবি।
সোমবার দুপুর পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এনসিটিবিকে কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি। তবে গতকাল মঙ্গলবার আবার অভ্যন্তরীণ দরপত্র দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত পেয়েছে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি।
দরপত্র বাতিল হওয়া তিন শ্রেণির মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল গত ১৯ মে, সপ্তম শ্রেণির ১৫ মে এবং অষ্টম শ্রেণির ২ জুন।
এনসিটিবির একাধিক সূত্র জানায়, এখন আবার দরপত্র আহ্বান করে এই তিন শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপাতে পাঁচ মাস সময় লাগতে পারে। তবে এটি আদর্শিক হিসাব। বাস্তবে সব সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোয় না। নভেম্বরে-ডিসেম্বরে মুদ্রণকারীরা নোট–গাইড ছাপানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আবার আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে পোস্টার ছাপানোর কাজও বাড়বে। সব মিলিয়ে জানুয়ারির শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যেই যাতে বই ছাপানোর কাজ শেষ করা যায়, সে চেষ্টা তারা করে যাচ্ছে। এ জন্য দরপত্র শেষে মুদ্রণকাজের জন্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করার সময় বই ছাপানোর সময় কমিয়ে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই মুদ্রণে পুনঃ দরপত্রের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল নির্দেশ পেয়েছেন। সে অনুযায়ী পুনঃ দরপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাঁরা আশা করছেন, যথাসময়েই শিক্ষার্থীদের হাতে বই দিতে পারবেন।
অন্যান্য শ্রেণির বইয়ের চিত্র
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানোর প্রক্রিয়া এগিয়েছে অনেকটাই। দরপত্র, মূল্যায়ন ও অনুমোদনের কাজও শেষ হয়েছে। প্রাক্-প্রাথমিকের বই ছাপাতে মুদ্রণকারীদের সঙ্গে এখন চুক্তি করছে এনসিটিবি। নিয়ম অনুযায়ী, চুক্তির পর ৭০ দিনের মধ্যে বই সরবরাহ করতে হবে। শিগগিরই প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের মুদ্রণও শুরু হবে।
নবম-দশম শ্রেণি এবং মাদ্রাসার ইবতেদায়ি স্তরের বইয়ের দরপত্র শেষ হলেও এখনো ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন পায়নি। শিগগিরই তা সম্পন্ন হবে বলে আশা করছে এনসিটিবি।
এনসিটিবির লক্ষ্য ছিল, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপানোর কাজ শেষ করা। তবে এখনকার পরিস্থিতি বলছে, প্রাথমিক স্তরে সংকট না থাকলেও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থী নতুন বছরের শুরুতে সব বই হাতে পাবে কি না, তা নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।