মঙ্গলবার, 9 সেপ্টেম্বর 2025
MENU
daily-fulki

মহানবী (সা.)-এর অনুপম চরিত্র ও উত্তম আদর্শ

ফুলকি ডেস্ক : দুনিয়ার সর্বশেষ নবী ও কালজয়ী আদর্শ ইসলামের অগ্রদূত মহানবী (সা.)। তিনি দুনিয়ায় কায়েম করেছিলেন একটি আদর্শ জীবনব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত ছিল পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবন চলার সব বিধান ও রীতিনীতি। তিনি ছিলেন সেরাদের সেরা মানুষ।

অনুপম আদর্শ ও চরিত্র মাধুর্যের মডেল। এ জন্য মহান আল্লাহ মহানবী (সা.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’
(সুরা : কালাম, আয়াত : ৪)

মুহাম্মদ (সা.)-এর  চরিত্র ও জীবন সম্পর্কে মহান আল্লাহর এই ঘোষণা ছিল একজন মানুষ তথা নবী সম্পর্কে সর্বোচ্চ সনদ। আল্লাহ তাআলা মানব সৃষ্টির পর থেকে যত মানুষ ও নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে মহানবী (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী।


তাঁর আনীত আদর্শও ছিল সর্বোত্তম। এ জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই অনুপম মানুষের অনন্য আদর্শকে গ্রহণ করার জন্য বিশ্বের মানুষকে তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১) 
মহানবী (সা.)-এর চরিত্রের অন্যতম গুণ ছিল, তিনি ছিলেন কোমল, উদার ও মহৎ হৃদয়ের মানুষ। মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে তিনি যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি মানুষের ভুলভ্রান্তি ক্ষমার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদার, ক্ষমাশীল ও কোমল।

আর এ জন্য আরবের বেয়ারা ও অজ্ঞ মানুষগুলো তাঁর সাহচর্য পেয়ে উন্নত মানুষে পরিণত হয়েছিল, তাঁর অনুগত হয়ে জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে উদগ্রীব ছিল। আর এটা এ জন্যই সম্ভব হয়েছিল যে আল্লাহর রাসুল (সা.) হৃদয়ের কোমলতা ও উদারতা দিয়ে সবাইকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন। আর তাদের ভুলভ্রান্তি উদার মনে ক্ষমা করতে পেরেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর এই চরিত্র মাধুর্যকে লক্ষ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছ, যদি তুমি রুঢ় ও কঠোর চিত্ত হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত।’
(সুরা : আলে-ইমরান, আয়াত : ১৫৯)

মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসুলকে মানবজাতির কাছে রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন।


মহানবী (সা.) সত্যিকার অর্থে ছিলেন রহমতের নবী। কারণ তাঁর হৃদয় ছিল রহমত ও হৃদ্যতায় পরিপূর্ণ। তিনি মানুষকে একান্ত আপনজন হিসেবে ভালোবাসতেন এবং মানুষের সব সমস্যা ও বিপদে তিনি সর্বাগ্রে উপস্থিত থাকতেন। এ জন্য আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আপনাকে কেবল সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’
(সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)

আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চরিত্র মাধুর্য এবং তাঁর সর্বোত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার সনদ ছাড়াও তাঁর স্ত্রী, সাহাবিরা, যাঁরা তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন। নবীজি (সা.)-এর সর্বোত্তম ব্যবহার ও কাজ সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। মহানবী (সা.) যেদিন নবুয়ত পেলেন, সেদিন তিনি হেরা পর্বত থেকে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি ভয় ও জীবনের আশঙ্কা থেকে খাদিজা (রা.)-কে বললেন, ‘আমি আমার জীবন নিয়ে আশঙ্কাবোধ করছি, তুমি আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তখন খাদজাি (রা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ আপনার কোনো ক্ষতি করবেন না। কারণ নিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, সত্য কথা বলেন, অভাবীর অভাব মোচন করেন, মেহমানের মেহমানদারি করেন এবং বিপদে মানুষকে সাহায্য করেন।’

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩)

আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরা অনেক সময় রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইতেন। একবার ইয়াজিদ (রা.) নবীজি (সা.)-এর স্ত্রী আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে উম্মুল মুমিনিন! রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র কিরূপ ছিল?’ জবাবে আয়েশা (রা) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র ছিল আল-কোরআন।’

(আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৪২)

আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চরিত্র মাধুর্য ও শিষ্টাচার সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবি আনাস (রা.)-এর বক্তব্য খুবই প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শিশুকাল থেকে দীর্ঘ ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বহু বছর খিদমত করেছি। (এই দীর্ঘ সময়ে) তিনি আমাকে কখনো গালি দেননি, মারধর করেননি, ধমক দেননি, চোখ রাঙাননি। আর এমন কোনো বিষয়ে তিনি আমাকে তিরস্কারও করেননি, যা তিনি আমাকে করতে আদেশ করেছেন অথচ আমি তা করতে আলস্য করেছি। তাঁর গৃহের কেউ যদি এ ব্যাপারে আমাকে ভর্ত্সনা করত, তবে তিনি বলতেন, আরে রাখো তো!’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৩৮)

আলফ্রেড ডিলা মারটিন রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘দার্শনিক বাগ্মী, ধর্ম প্রবর্তক, সেনানায়ক, আইন প্রণেতা, ভাবের বিজয়কর্তা, যুক্তিসংগত ধর্মমতের প্রবর্তক ও প্রতিমাবিহীন ধর্মপদ্ধতির সংস্থাপক, কুড়িটি পার্থিব সাম্রাজ্য এবং একটি ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ (সা.)-এর দিকে তাকিয়ে দেখো। মানুষের মহত্ত্বের যতগুলো মাপকাঠি আছে, সেসব দিয়ে তুলনা করলে তাঁর চেয়ে মহত্তর কোনো লোক ইতিহাসে পাবে কি?’

এ জি লিওনার্দ বলেছেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু মহৎই নন, বরং সত্যের শীর্ষে আরোহণকারীদের অন্যতমও। তিনি শুধু নবী বা ধর্ম প্রবর্তক হিসেবেই মহৎ নন, দেশপ্রেমিক হিসেবেও তিনি মহান। তিনি দুনিয়া ও আখিরাতের পথনির্দেশক-পার্থিব ও অধ্যাত্ম সরণি-নির্মাতা। তিনি গড়ে তুলেছেন একটি মহান জাতি এবং একটি সুবিশাল সাম্রাজ্য। তিনি সত্যের উৎস। তিনি নিজে সত্য তাঁর নিজের কাছে, তাঁর অনুসারীদের কাছে। তাঁর পরিচিত-অপরিচিতদের কাছে এবং সর্বোপরি তাঁর রবের কাছে।’

জন ডেভনপোর্ট বলেন, ‘এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে সব আইন প্রণয়নকারী ও বিজয়ীদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যার জীবনী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত থেকে অধিক বিস্তৃত ও সত্য।’

জর্জ বার্নার্ড শ আরো এগিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা বিস্ময়কর। তিনি বলেন, ‘যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোনো লোক বর্তমান বিশ্বের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তবে তিনি এর সমস্যার এমনভাবে সমাধান করতেন, যাতে জগতে বহুল আকাঙ্ক্ষিত চিরস্থায়ী শান্তি ও সুখ আনতে সমর্থ হতেন। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, আর আমার মতো একজন বিজ্ঞ লোকের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হবে না যে সমগ্র ইউরোপে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সংস্কারকৃত ইসলাম অথবা তার নিয়মাবলি গ্রহণ করবে।’

আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজেই সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন না, তিনি তাঁর অনুগত সাহাবিদের জীবনকেও সেই আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন। কালের পরিক্রমায় যারা যুগ যুগ ধরে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও জীবনবিধানের অনুসারী হবে, তাদের জন্যও একই নীতি গ্রহণের জন্য তিনি তাগিদ দিয়েছেন।

আজকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও অশান্ত পৃথিবীর পরতে পরতে যে অমানবিকতা, পৈশাচিকতা, ধর্মহীনতা, আদর্শচ্যুতি এবং বর্বরতার সয়লাব চলছে, মানুষের মধ্যে যে অমানুষিক আচরণ ও পশুত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার অভিশাপ থেকে জাতি, রাষ্ট্র ও মানবতাকে রক্ষার জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মতো চরিত্রবান ও নীতিবান মানুষের খুবই প্রয়োজন।

 

সর্বাধিক পঠিত