ফুলকি ডেস্ক : কক্সবাজার শহরের পশ্চিম পাশে বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট ছিল একসময়ের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই ঘাট দিয়ে কক্সবাজার শহর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলাচল করত জাহাজ ও যাত্রীবাহী লঞ্চ। এখন সবই স্মৃতি। এ জায়গাতে অন্তত ৩০০ একরের বেশি প্যারাবন ধ্বংস ও নদী ভরাট করে নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক পাকা-সেমিপাকা ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা।
শুধু কস্তুরাঘাট নয়, এভাবে নুনিয়াছাটা থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাকখালী নদী দখল করে নির্মিত হয়েছে সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা। এ অবস্থায় বাকখালী নদী দখল করে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে আজ সোমবার অভিযানে নামছে সরকার। বিআইডব্লিউটিএ’র সহযোগিতায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন যৌথ এ অভিযান পরিচালনা করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. খায়রুজ্জামান বলেন, বাকখালী নদী দখল করে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য ১ সেপ্টেম্বর থেকে অভিযান শুরু করা হবে। অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলমান থাকবে। অভিযান চলাকালীন সময়ে যাতে কোন ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয়, এজন্য পুলিশ, কোস্ট গার্ডের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও র্যাব উপস্থিত থাকবে।
জানা যায়, বাকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের পৃথক তালিকা তৈরি করেছে স্থানীয় ভূমি অফিস এবং বিআইডব্লিউটিএ। সহস্রাধিক অবৈধ দখলদার থাকলেও দুই তালিকায় স্থান পেয়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ জন প্রভাবশালী। এরমধ্যে রয়েছে- কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম, কক্সবাজার পৌর বিএনপির সভাপতি রফিকুল হুদা চৌধুরী ও এবি পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কাশেমের নামও।
তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে কক্সবাজার পৌর বিএনপির সভাপতি রফিকুল হুদা চৌধুরী বলেন, আমি বাকখালী নদীর কোন জমি দখল করি নাই, এগুলো আমার পৈত্রিক সম্পত্তি।
জানা যায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে উৎপত্তি হয়ে ৮১ কিলোমিটারের বাকখালী নদীটি রামু ও কক্সবাজার সদর হয়ে শহরের কস্তুরাঘাট-নুনিয়াছটা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি দখলের ঘটনা ঘটেছে। গত ১০ থেকে ১২ বছরে এই ছয় কিলোমিটারে ১ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ যৌথ অভিযান চালিয়ে চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। তখন দখলমুক্ত করা হয় বাঁকখালী নদীর ৩০০ একরের বেশি প্যারাবনের জমি। কিন্তু গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, উচ্ছেদ করা প্যারাভূমিতে ফের নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। অনেকে টিনের বেড়া দিয়ে শত শত একর জলাভূমি ঘিরে রেখেছেন। কস্তুরাঘাট থেকে সেতুর দিকে যেতে সড়কের পূর্ব পাশে পাহাড়সমান বর্জ্যের স্তূপ চোখে পড়ে। শহরের ময়লা আবর্জনা ট্রাকে ভরে এখানে ফেলা হচ্ছে। খননযন্ত্র দিয়ে সেই বর্জ্য নিচু জায়গায় ভরাট করা হচ্ছে
স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশকর্মীরা বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর টানা ৪৫ দিনে প্যারাবনের উচ্ছেদ করা জায়গায় ফের ঘরবাড়ি নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। এ পর্যন্ত কেউ বাধা দেয়নি।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) চেয়ারম্যান মুজিবুল হক বলেন, কক্সবাজার পৌরসভা থেকে খুরুশকুলে যাতায়াতের জন্য নির্মিত সেতুর কারণেই ঐতিহ্যবাহী নদীর মরণদশা যাচ্ছে। দেড় মাইল প্রস্থের নদীটি সংকুচিত হয়ে সেতুর গোড়ার অংশ এখন ২০০ ফুটের কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। তাতে নৌচলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও পর্যটন শহরে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় ৯৭ টনের বেশি বর্জ্য। এর মধ্যে ৭০ টন বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। অবশিষ্ট বর্জ্য সাগরে চলে যাচ্ছে। বছরের পর বছর বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর বুক এখন ময়লার পাহাড়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত শনিবার কক্সবাজার সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে ‘হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক বাঁকখালী নদী দখলমুক্তকরণের লক্ষে বিশেষ সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় নৌপরিবহণ উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের উপস্থিতিতে বাকখালী নদী রক্ষায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নদী দখল করে নির্মিত সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এরপর নদীর সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
এদিকে গত ২৪ আগস্ট বাঁকখালী নদীর সীমানায় থাকা সব দখলদারের তালিকা তৈরি করে আগামী চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে নদীটিকে আগামী ৬ মাসের মধ্যে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা ও সে মোতাবেক ব্যবস্থাপনা নেওয়ারও নির্দেশ দেন আদালত।
হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, বাঁকখালী নদীর বর্তমান প্রবাহ এবং আরএস জরিপের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণপূর্বক নদীটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। নদীর সীমানায় বিদ্যমান দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে আগামী ৪ মাসের মধ্যে তা উচ্ছেদের ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি পূর্বে প্রদত্ত রুল চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে নদী এবং নদী সংলগ্ন এলাকা ভিন্ন উদ্দেশ্যে ইজারা প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে, নদী এলাকার ম্যানগ্রোভ বন ফিরিয়ে আনতে এবং নদী এলাকায় ইতঃপূর্বে প্রদান করা সব ইজারা বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায় অনুযায়ী, নদীটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়মিত তদারকির স্বার্থে মামলাটিকে আদালত চলমান মামলা হিসেবে ঘোষণা করে প্রতি ৬ মাস পর পর অর্থাৎ প্রতিবছর জানুয়ারি ও জুলাই মাসে উল্লিখিত নির্দেশ প্রতিপালন প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা একটি মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কাজী জিনাত হক এবং বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দীকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ এ রায় দেন।