জাকসু: মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাঁচ প্যানেল
জাবিপ্রিতিনিধি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে পাঁচটি প্যানেলের মধ্যে। তবে কোনো প্যানেলই এককভাবে সব পদে জয়ী হতে পারবে না বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, এবারের জাকসু নির্বাচনে দল বা প্যানেল হিসেবে নয়; বরং প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বেশি মূল্যায়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর বিগত দিনের কর্মকাণ্ড ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থেকে ভূমিকা পালনের বিষয় ভোটারদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলবে।
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আগামী ১১ সেপ্টেম্বর জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জাকসুতে ২৫টি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ১৭৯ জন। শীর্ষ দুই পদ সহসভাপতিতে (ভিপি) ১০ জন এবং সাধারণ সম্পাদকে (জিএস) ৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
জাকসু নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সাতটি প্যানেল ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেল, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’, বামপন্থী সংগঠনগুলোর ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ এবং ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
এর বাইরে বামপন্থী সংগঠনগুলোর অপর অংশের ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ নামে পাঁচ সদস্যের আংশিক প্যানেল ও জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের মুখপাত্র মাহফুজ ইসলামের নেতৃত্বে আট সদস্যের ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ নামে আরেকটি আংশিক প্যানেল রয়েছে। এর বাইরে অনেক প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন।
এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানা রিথী বলেন, ‘ঘোষিত প্যানেলগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্যানেলই এককভাবে জয়ী হতে পারবে না। কারণ, এটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা সবাই সবাইকে চিনি। ব্যক্তি হিসেবে যাঁর যত বেশি পরিচিতি এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি ও বিগত দিনের রেকর্ড ভালো, তাঁরাই জয়ী হবেন।’
জাকসুর শীর্ষ দুই পদ ভিপি ও জিএসে অন্য কোনো প্যানেল নারীকে প্রার্থী না করলেও জিএসে তা করেছে ছাত্রদল। ছাত্রদলের প্যানেল থেকে জিএস পদে রাখা হয়েছে সংগঠনটির একটি হলের সভাপতি তানজিলা হোসাইনকে।
ভোট টানতে বিভিন্ন কৌশল
জাকসু নির্বাচনে জয়ী হতে সংগঠনগুলো নানা হিসাবনিকাশ থেকে তাদের প্যানেল ঘোষণা করেছে। এসব প্যানেলের মধ্যে বামপন্থী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে সম্প্রীতির ঐক্য নামে যে প্যানেল ঘোষণা করেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি—১১ জন নারী ও ৭ জন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী প্রার্থী হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের একটি অংশ রয়েছে। তাঁদের ভোট টানতেই মূলত তারা বেশিসংখ্যক এমন প্রার্থী রেখেছে। এ ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ভোট টানতে ‘সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের’ কয়েকজনকে এই প্যানেলে রাখা হয়েছে। এর বাইরে ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক ও বিতর্ক সংগঠনের অনেক পরিচিত মুখকে রাখা হয়েছে প্রার্থী হিসেবে।
এদিকে জাকসুর শীর্ষ দুই পদ ভিপি ও জিএসে অন্য কোনো প্যানেল নারীকে প্রার্থী না করলেও জিএসে তা করেছে ছাত্রদল। ছাত্রদলের প্যানেল থেকে জিএস পদে রাখা হয়েছে সংগঠনটির একটি হলের সভাপতি তানজিলা হোসাইনকে। বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, মূলত নারী ভোটার টানতেই ছাত্রদল দ্বিতীয় শীর্ষ পদে তানজিলাকে মনোনয়ন দিয়েছে। এ ছাড়া প্যানেলটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ ব্যাচের ‘বি’ ও ‘ডি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম হওয়া দুজন শিক্ষার্থীকে রাখা হয়েছে। জাকসু নির্বাচন সামনে রেখে কিছুদিন আগে ছাত্রদল হল কমিটি ও শাখা আহ্বায়ক কমিটি বর্ধিত করেছে। এসব কমিটিতে মোট ৫৩৫ জনকে পদ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে এসব দলীয় ব্যক্তির ভোট ও কর্মকাণ্ড ছাত্রদলকে কয়েকটি পদে এগিয়ে রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ছাত্ররাজনীতিতে সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ক্যাম্পাসে টেকসই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে। যা দেশের জাতীয় রাজনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এবারের জাকসু নির্বাচনে এককভাবে কোনো দলের বের হয়ে আসার সম্ভাবনা কম।
স্থানীয় সরকার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম
গণ-অভ্যুত্থানের পর জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেল এবং জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজনের নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলও নির্বাচনে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত প্যানেলে নারী শিক্ষার্থীদের ভোট টানতে ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত ছয়টি পদের বাইরেও দুটি পদে নারী প্রার্থী রাখা হয়েছে। হলগুলোতে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ প্যানেল দিতে না পারলেও যাঁরা এককভাবে নির্বাচন করছেন, তাঁদের মাধ্যমে হলের শিক্ষার্থীদের ভোট টানতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে তাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে গঠিত প্যানেল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জিতু জুলাই আন্দোলনের আগে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে এক হাজারের বেশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মী রয়েছেন। জাকসু নির্বাচনে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ভোটগুলোর বেশির ভাগই ভিপি পদে জিতুর দিকে যেতে পারে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একটি পক্ষও জিতুকে সমর্থন দিচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আলোচিত শিক্ষার্থী শাকিল আলী এই প্যানেল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করছেন। ফলে জুলাই আন্দোলনে ভূমিকার জন্য এই প্যানেলের কয়েকজন নির্বাচনে নিজ নিজ পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। অপর দিকে ১৯৮৯ সালের পর থেকে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য রাজনীতিতে না থাকা ছাত্রশিবিরের প্যানেলেও জুলাই আন্দোলনে আহতদের কয়েকজন রয়েছেন। তাঁরাও জাকসু নির্বাচনে কয়েকটি পদে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষার্থী।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক স্থানীয় সরকার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, ছাত্ররাজনীতিতে সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ক্যাম্পাসে টেকসই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে। যা দেশের জাতীয় রাজনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এবারের জাকসু নির্বাচনে এককভাবে কোনো দলের বের হয়ে আসার সম্ভাবনা কম। ভোটাররা ভোটদানের ক্ষেত্রে সচেতনতার সঙ্গে যোগ্য প্রার্থী বিবেচনায় নেবেন।