বৃহস্পতিবার, 9 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

জ্বালানি তেল ‘চুরি’ করতে যমুনা অয়েলে অভিনব জালিয়াতি


স্টাফ রিপোর্টার : তেল ‘চুরি’ করতে অভিনব জালিয়াতির একটি ঘটনা ঘটেছে সরকারি মালিকানাধীন জ্বালানি তেল বিপণনের প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে।

এ ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল পরিবহনে একটি ট্যাংকলরির তেল ধারণের প্রকৃত সক্ষমতা গোপন করে চুক্তি করা হয়। লরিটি সাড়ে ১৩ হাজার লিটারের; কিন্তু চুক্তিতে দেখানো হয় ৯ হাজার লিটারের।

যমুনা অয়েল কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ট্যাংকলরিটির সাড়ে চার হাজার লিটার বাড়তি ধারণ সক্ষমতা গোপন করে চুক্তির ঘটনাটি অভিনব। উদ্দেশ্য লরিতে বাড়তি তেল দিয়ে ডিপোর বাইরে পাঠিয়ে চুরি করা।


এই জালিয়াতির সঙ্গে যমুনা অয়েল কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা ও ট্যাংকলরিমালিক জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

যমুনা অয়েল কোম্পানি সূত্র বলছে, খুলনার দৌলতপুর ডিপো থেকে তেল পরিবহনের জন্য গত ২৭ জুলাই মেসার্স আছিয়া এন্টারপ্রাইজের একটি ট্যাংকলরির সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তির কয়েক দিন পর ট্যাংকলরিটিতে করে বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ডিজেল পাঠানো হয়; কিন্তু ট্যাংকলরিটির ধারণ সক্ষমতায় অসামঞ্জস্য দেখতে পেয়ে ডিজেল গ্রহণে অসম্মতি জানান বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

আছিয়া এন্টারপ্রাইজের ট্যাংকলরিটির ধারণ সক্ষমতার অসামঞ্জস্য ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল গ্রহণে আপত্তির খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন এই অসামঞ্জস্যতার বিষয়টি নিয়ে যমুনা অয়েল কোম্পানির কাছে আপত্তি জানান ট্যাংকলরির মালিক ও শ্রমিকেরা।

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ট্যাংকলরি শ্রমিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, সাড়ে ১৩ হাজার লিটারের লরি; কিন্তু জালিয়াতি করে দেখানো হয় ৯ হাজার লিটার। এটা করার কোনো নিয়ম নেই। এ কারণে মালিক-শ্রমিক সবাই আপত্তি জানিয়েছেন।

সড়কপথে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য পরিবহনের জন্য সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি যমুনা, পদ্মা, মেঘনায় ট্যাংকলরি ভাড়ায় নেওয়া হয়। এ জন্য লরির প্রয়োজনীয় সব তথ্য ঠিক থাকতে হয়।
তেল পরিবহনের ভাড়া চুক্তি করার আগে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে লরির সক্ষমতা যাচাই (ক্যালিব্রেশন) করে সনদ নিতে হয়।

যমুনার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র বলছে, চুক্তিতে উল্লেখ করা আছিয়া এন্টারপ্রাইজের ট্যাংকলরিটির নম্বর ‘ঢাকা মেট্রো-ঢ-৪২-০০১২ ’। বিএসটিআই থেকে নেওয়া সনদের একটি প্রতিলিপি যমুনায় জমা দেওয়া হয়েছে। এতে লরিটির তেল ধারণের সক্ষমতা ৯ হাজার লিটার দেখানো হয়েছে।

যমুনা অয়েল কোম্পানি সূত্র বলছে, খুলনার দৌলতপুর ডিপো থেকে তেল পরিবহনের জন্য গত ২৭ জুলাই মেসার্স আছিয়া এন্টারপ্রাইজের একটি ট্যাংকলরির সঙ্গে চুক্তি হয়।
সনদ অনুযায়ী, গত ২৫ জুন ক্যালিব্রেশন করে স্বাক্ষর করেছেন বিএসটিআই খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আলাউদ্দিন হুসাইন।

সনদটি যাচাই করতে বিএসটিআই খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে যোগাযোগ করে । কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সনদে স্বাক্ষরকারী এই কর্মকর্তা গত জানুয়ারিতে ঢাকায় বদলি হয়ে গেছেন। তাই তাঁর স্বাক্ষর করার কোনো সুযোগ নেই। আসলে সনদটি জাল।

সনদে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করে ‘ঝিনাইদহ-ঢ-৪১-০০৩৮’ নম্বর গাড়ির ক্যালিব্রেশন প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া। এই গাড়িটিও আছিয়া এন্টারপ্রাইজের। মালিক নাম মো. মানিক শেখ।
মানিক শেখ  বলেন, তিনি ভুল করে বেশি ধারণক্ষমতার লরি দিয়ে কম তেল পরিবহনের চুক্তিটি করেছেন। বাড়তি তেল নেওয়ার জন্য লরির প্রকৃত ধারণ সক্ষমতা কম দেখাননি। আপত্তির কারণে তিনি চুক্তিটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

১৮ আগস্ট যমুনার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি চিঠি দেয় আছিয়া এন্টারপ্রাইজ। চিঠিতে বলা হয়, ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক জটিলতার কারণে ট্যাংকলরিটি পরিচালনা করা যাচ্ছে না। তাই চুক্তি বাতিল করে জামানতের ৫ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
দুটি চিঠির ভাষা একই। চিঠিতে বলা হয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদনের ভিত্তিতে ট্যাংকলরিটিকে তেল পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়; কিন্তু ট্যাংকলরিটি ৯ হাজার লিটারের উল্লেখ করা হলেও এটি মূলত সাড়ে ১৩ হাজার লিটারের। ৯ হাজার লিটারের লরিতে দুটি চেম্বার থাকে। এই গাড়িতে তিনটি চেম্বার আছে। এতে যমুনা অয়েল কোম্পানি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই ট্যাংকলরির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হলো।

যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তফা কুদরত-ই ইলাহী  বলেন, বাস্তব ধারণ ক্ষমতা ও সনদের তারতম্যের কারণে লরিটির সঙ্গে চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে। চুক্তির আগেই বিষয়টি যাচাই করার কথা; কিন্তু কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কীভাবে এটা হলো তা তদন্ত করা হবে।

চুক্তি বাতিলে একাধিক চিঠি ও চুক্তি বাতিল নিয়ে দুই পক্ষের ভিন্ন বক্তব্যের বিষয়ে তদন্তের পর মন্তব্য করবেন বলে জানান মুস্তফা কুদরত-ই-ইলাহী।

তবে যমুনা অয়েল কোম্পানির দুজন কর্মকর্তা  বলেন, চুরির তেল ট্যাংকলরিতে করেই ডিপোর বাইরে যায়। প্রতি লরিতে কিছু কিছু করে বাড়তি তেল দিয়ে দেওয়া হয়। চুরির এই তেল পরে কারিগরি ক্ষতি হিসেবে দেখানো হয়। ফলে লরির সাড়ে চার হাজার লিটার বাড়তি সক্ষমতা গোপনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। কারণ, যমুনায় জ্বালানি তেল চুরির ঘটনা নতুন নয়।

 

সর্বাধিক পঠিত